বেরোবির সাবেক উপাচার্য ড. কলিমুল্লাহ গ্রেফতার: ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে নেওয়া হয়েছে,

স্টাফ রিপোর্টার: মো. শাহজাহান বাশার
ঢাকা | প্রকাশকাল: বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট ২০২৫

ঢাকা: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি), রংপুর-এর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) তাকে রাজধানী ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

গ্রেফতারের পরপরই তাকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। ডিবি সূত্র বলছে, তাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সম্ভাব্য অর্থপাচারের বিষয়।

তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেননি। তবে সূত্রমতে, আজ (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে একটি বিশেষ প্রেস ব্রিফিং আয়োজন করা হবে, যেখানে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, গ্রেফতারের পটভূমি এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হতে পারে।

অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার পুরো মেয়াদকালজুড়েই তাকে ঘিরে ছিল বিস্তর বিতর্ক ও সমালোচনা। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাধিক আন্দোলন, অনশন এবং মানববন্ধন হয়েছে তার পদত্যাগের দাবিতে।

অভিযোগসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:

  • নিয়োগ বাণিজ্য: অদক্ষ ও দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া, যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করা।

  • প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা: সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শিক্ষক পরিষদকে উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো।

  • শিক্ষা ও গবেষণায় স্থবিরতা: একাধিক বিভাগে নিয়মিত ক্লাস ও গবেষণার অভাব, শিক্ষক সংকট থাকা সত্ত্বেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া।

  • বাজেট ও টেন্ডার দুর্নীতি: উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম, আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশে গড়িমসি, নিরীক্ষা প্রতিবেদন গোপন রাখার অভিযোগ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদ থেকে বিদায় নিলেও তার বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একাধিক লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে এবং কয়েকটি অভিযোগ দুদকেও পাঠানো হয়।

উল্লেখ্য, উপাচার্যের দায়িত্ব শেষ করার পর অধ্যাপক কলিমুল্লাহ নিজ উদ্যোগে গঠন করেন ‘জনতার কমিশন’ নামের একটি বিতর্কিত সংগঠন, যার কার্যক্রম নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এই সংগঠনের নামে দেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নানা একতরফা ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রচার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

ড. কলিমুল্লাহর গ্রেফতারের খবরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী, সাবেক ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে যেসব অভিযোগ করে আসছিলাম, সেগুলোর তদন্ত হওয়া জরুরি। তার গ্রেফতার সে দিকেই অগ্রগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।”

অন্যদিকে তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র দাবি করেছে, এই গ্রেফতার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তিনি ‘একটি প্রভাবশালী মহলের চক্ষুশূল’ হওয়ায় তাকে হয়রানি করা হচ্ছে।

ডিবির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট তথ্য ও নথি রয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হতে পারে। এছাড়া তার ব্যাংক হিসাব, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

ড. কলিমুল্লাহর গ্রেফতার এই প্রশ্নকে সামনে এনে দিয়েছে—বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে চলা প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা, অযোগ্য নিয়োগ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির যে সংস্কৃতি, তা শেষ পর্যন্ত কীভাবে প্রতিরোধ হবে?

একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে যদি এত অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলতাও প্রশ্নবিদ্ধ।

অতএব, গ্রেফতার যেন শুধুই আইওয়াশ না হয়; বরং প্রশাসনিক শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় এটি যেন হয় একটি দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ—এমনটাই আশা করছে সচেতন মহল।