স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে ঘরের কোণায় লুকিয়ে রাখেন স্বামী; পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পাষণ্ড সুমন

মো. শাহজাহান বাশার | স্টাফ রিপোর্টার

১০ জুলাই:
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন রৌফাবাদ পাহাড়িকা হাউজিংয়ের এক বহুতল ভবনে ঘটে গেলো এক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড। প্রেম ও বিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ এক দম্পতির সংসার রক্তাক্ত ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়েছে। স্ত্রীকে গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করে মরদেহ টুকরো টুকরো করে নিজ বাসার বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন স্বামী। পুলিশের ধারণা—এটি একটি পরিকল্পিত ও ভয়ংকর পারিবারিক হত্যাকাণ্ড।

ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে, চট্টগ্রাম নগরের রৌফাবাদ পাহাড়িকা হাউজিং এলাকার এফজেড টাওয়ারের একটি ফ্ল্যাটে। নিহতের নাম ফাতেমা আক্তার (২০) এবং অভিযুক্ত স্বামীর নাম সুমন (২৫), যিনি পেশায় একজন গাড়িচালক।

প্রতিবেশীদের সন্দেহ হয় যখন তারা ফ্ল্যাটটি থেকে দুর্গন্ধ ও অস্বাভাবিক শব্দ লক্ষ্য করেন। কয়েকদিন ধরেই ওই বাসা থেকে কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। ভয় পেয়ে তারা বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশকে অবহিত করেন।

পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে দেখতে পায়, ফ্ল্যাটটির দরজা ভেতর থেকে আটকানো। পরে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় দরজা ভেঙে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে পুলিশ—আর সেখানেই মিলল বিভৎস দৃশ্য।

ফ্ল্যাটের মেঝেতে ও বিভিন্ন স্থানে মাংসপিণ্ড ও দেহের খণ্ড-বিখণ্ড অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কিছু অংশ ফ্রিজেও রাখা হয়েছিল বলে একটি সূত্র দাবি করে। ফাতেমার মাথা ও গলা আলাদা অবস্থায় পাওয়া যায়, যার ওপর ছিল ধারালো অস্ত্রের আঘাতের সুস্পষ্ট চিহ্ন।

বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান বলেন,

“প্রাথমিকভাবে আমরা মনে করছি, পারিবারিক কলহের জের ধরেই ফাতেমাকে হত্যা করা হয়েছে। গলা কেটে হত্যা করার পর মরদেহকে একাধিক টুকরো করে ঘরের বিভিন্ন জায়গায় রেখে দেওয়া হয়। হত্যার ধরন অত্যন্ত নিষ্ঠুর। এই ঘটনার পেছনে আরও গভীর কোনো কারণ থাকতে পারে বলেও আমরা সন্দেহ করছি।”

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, দম্পতির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল। মাঝে মধ্যেই উচ্চস্বরে ঝগড়াঝাঁটি করতেন তারা। তবে তাদের সম্পর্ক কতটা তিক্ত ছিল—তা এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডই প্রমাণ করে দিয়েছে।

নিহত ফাতেমা আক্তার ছিলেন মাত্র ২০ বছর বয়সী এক তরুণী। তার আত্মীয়স্বজনরা জানান, ফাতেমা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন সুমনকে। পরিবারের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি সংসার শুরু করেন স্বামীর সঙ্গে। শুরুতে ভালোবাসার সংসার মনে হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা রূপ নেয় সহিংসতায়।

তার এক আত্মীয়া বলেন, “ফাতেমা প্রায়ই ফোনে বলত সুমন সন্দেহ করে, মারধর করে, খেতে দেয় না। আমরা বুঝিনি বিষয়টা এতটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে।”

ঘটনার পর থেকেই সুমন পলাতক। পুলিশ বলছে, তিনি হয়তো হত্যার পরপরই পরিকল্পিতভাবে বাসা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
বন্দর, বাস টার্মিনাল, ট্রেন স্টেশন ও সীমান্তবর্তী এলাকায় তার ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তার মোবাইল ফোন বন্ধ এবং তার শেষ অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের বাইরে, এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

পুলিশের তদন্তে আরও জানা গেছে, সুমনের মানসিক ভারসাম্য নিয়েও কিছু প্রশ্ন রয়েছে। পূর্বে কয়েকবার তাকে রাগের বশে সহিংস হতে দেখা গেছে বলে প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন।

পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে। সেখানে ময়নাতদন্তের মাধ্যমে হত্যার সময়, অস্ত্র এবং নির্যাতনের ধরন সম্পর্কে বিশদ জানা যাবে। মরদেহ এতটাই বিকৃত অবস্থায় ছিল যে, তা শনাক্ত করতেও সময় লেগেছে বলে জানায় ফোরেনসিক টিম।

চমেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই ধরনের হত্যাকাণ্ড শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক বিকৃতিরও বহিঃপ্রকাশ।”

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন,

“এটি একটি বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। আমরা অতি দ্রুত অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনবো। তার বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করা হবে মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো কঠিন ধারায়।”

পুলিশ ইতোমধ্যে ফ্ল্যাটের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি মরদেহের কাছ থেকে উদ্ধার করা চাপাতি, ছুরি ও দড়ি ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।

এই মর্মান্তিক ঘটনা আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়—পারিবারিক সহিংসতা কেবল গালাগাল বা শারীরিক আঘাতে সীমাবদ্ধ নয়, তা কখনো কখনো জীবন কেড়ে নেয়। এক তরুণী তার সব স্বপ্ন, আশা ও ভালোবাসা নিয়ে ঘর বেঁধেছিল, সেই ঘরেই তার রক্তে রাঙা হলো চার দেয়াল।

সমাজ, প্রশাসন, পরিবার—সবাইকে এখন প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কীভাবে এমন বিকারগ্রস্ত হত্যাকারীদের আগেই চিনে প্রতিরোধ করতে পারি? কত তরুণীকে এভাবে প্রাণ হারাতে হবে—তবে কি আমরা সতর্ক হব?