পারিবারিক শিক্ষা অপরিহার্য

লেখক: মো. শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আমরা নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, শিশু-কিশোরদের বিপথগামিতা এবং মূল্যবোধহীনতা লক্ষ্য করছি। এসব সমস্যার মূলে গিয়ে দেখা যায়, আমাদের পারিবারিক শিক্ষার অভাব একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা মানেই শুধু স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ নয়—একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন থেকেই তার প্রথম পাঠশালা হয় পরিবার। পারিবারিক শিক্ষাই শিশুর চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ, নৈতিকতা, সামাজিকতা এবং ভবিষ্যতের পরিচয় গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
পারিবারিক শিক্ষা কী এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ?: পারিবারিক শিক্ষা বলতে বোঝায় বাবা-মা, দাদা-দাদি, বড় ভাই-বোন কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে শিশু যা শিখে—তা-ই। যেমন: কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে চলাফেরা করতে হয়, কীভাবে অন্যকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়, কীভাবে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, এমনকি কীভাবে অন্যকে ভালোবাসতে হয়। এই শিক্ষা শিশুর ভেতর মূল্যবোধ, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহানুভূতি এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে।

পরিবারের সদস্যদের মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সহযোগিতার পরিবেশ থাকলে, তা শিশুর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। শিশু তখন শিখে—সংঘাত নয়, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। এভাবেই গড়ে ওঠে একটি সুস্থ ও মানবিক মনোভাব। বর্তমান সমাজে পারিবারিক শিক্ষার অবহেলা : অভিভাবকদের ব্যস্ত জীবনযাপন, স্মার্টফোন আসক্তি, টেলিভিশন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত আসক্তি এবং পারস্পরিক সম্পর্কের দূরত্ব আজকালকার শিশুদের একাকী করে তুলেছে। অনেক সময় বাবা-মা মনে করেন, সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়ালেই যথেষ্ট। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখানো পাঠ তখনই কাজে আসে, যখন শিশুর মধ্যে পূর্ব থেকেই একটি নৈতিক ও আবেগীয় ভিত্তি তৈরি থাকে। সেটি গড়ে দেয় পরিবার।

কখনো কখনো আমরা দেখি, সন্তান খারাপ পথে গেলে অভিভাবকরা শুধুই স্কুল বা সমাজকে দোষারোপ করেন। কিন্তু তারা ভুলে যান, শিশুর প্রাথমিক অভিজ্ঞতা তো পরিবার থেকেই আসে। যদি পরিবারে অবজ্ঞা, গালাগালি, হিংসা বা অনৈতিকতা বিদ্যমান থাকে, তবে শিশুও স্বাভাবিকভাবেই সেই রূপ ধারণ করে।
পারিবারিক শিক্ষায় ধর্মীয় ও নৈতিক চর্চার ভূমিকা: পারিবারিক শিক্ষায় ধর্মীয় অনুশাসন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতিটি ধর্মই মানবিকতা, সততা, পরোপকার, শ্রদ্ধাবোধ, শৃঙ্খলা ও শান্তির শিক্ষা দেয়। সন্তানদের যদি ছোটবেলা থেকেই নামাজ, প্রার্থনা, দান, দয়ালুতা, প্রতিবেশীকে সাহায্য করা ইত্যাদি অভ্যাস করানো হয়, তাহলে তারা আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।
একইভাবে, পারিবারিক আড্ডা, যৌথ খাবার গ্রহণ, গল্প শোনা বা শোনানো, বড়দের সম্মান জানানো—এসব নৈতিক শিক্ষা শিশুর হৃদয়ে চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে যায়। এটি তাদের আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক দক্ষতা বাড়ায়।

১. অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানো: সন্তানকে শুধু মোবাইল বা ভিডিও গেম দিয়ে শান্ত রাখা নয়, বরং তার সঙ্গে সময় কাটানো, কথা বলা, অনুভব করা—এসবই পারিবারিক শিক্ষার অংশ। ২. সাপ্তাহিক পারিবারিক সময় নির্ধারণ: যেমন, একদিন সবাই একসঙ্গে খেতে বসা, কোনো ভালো বই বা সিনেমা নিয়ে আলোচনা, পারিবারিক গল্প বলা। ৩. সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক: কঠোর নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং বন্ধুর মতো শোনার অভ্যাস গড়ে তুললে শিশুরা নিজের ভুলগুলো স্বীকার করতে শেখে। ৪. নমুনা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করা: বাবা-মা যদি সৎ, দায়িত্বশীল ও সহনশীল হন, তবে সন্তানরাও তেমনই হবে। ৫. শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ও আবেগিক দিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা: তারা কেমন অনুভব করছে, কোনো সমস্যা হলে তা তারা খোলাখুলি বলতে পারছে কি না, এসব নিয়েও খেয়াল রাখা জরুরি।
সমাজের উন্নয়ন কিংবা একটি জাতির ভবিষ্যৎ গঠনের ক্ষেত্রে পরিবার হল সবচেয়ে বড় ভূমিকার অধিকারী। যদি পরিবারেই শিশুদের সঠিকভাবে গড়ে তোলা না যায়, তাহলে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা আইন দিয়ে একটি আদর্শ সমাজ গঠন সম্ভব নয়। তাই আজকের দিনে পারিবারিক শিক্ষা কেবল প্রয়োজন নয়, বরং তা অপরিহার্য। পরিবারের প্রতিটি সদস্যকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে—শুধু বাবা-মা নয়, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, চাচা-চাচিও। একটি ভালো মানুষ তৈরি হয় পরিবার থেকেই—এ কথা আমরা ভুলে গেলে চলবে না।