
মোঃ শাহজাহান বাশার,স্টাফ রিপোর্টার
মধ্যপ্রাচ্যের বুকে বারুদের গন্ধ যেন এখন স্থায়ী হয়ে উঠেছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সর্বশেষ সংঘর্ষ শুধু দুটি রাষ্ট্রের সীমিত যুদ্ধ নয়—বিশ্বের বহু বিশ্লেষক একে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বসূচনা বলেই মনে করছেন। যুদ্ধের উত্তাপ এখন শুধু গাজা, তেহরান বা তেলআবিবে সীমাবদ্ধ নেই—এর প্রতিধ্বনি পৌঁছে যাচ্ছে মস্কো, ওয়াশিংটন, লন্ডন, বেইজিং পর্যন্ত। পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ হামলা ও যুদ্ধঘোষণার মতো কার্যক্রম পরিস্থিতিকে গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
গত শুক্রবার ইসরায়েল যখন ইরানের মাটিতে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামক সামরিক হামলা চালায়, তখন থেকেই শুরু হয় আধুনিক সময়ের অন্যতম ভয়ংকর সংঘাত। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল বহুদিন ধরেই এই হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইরান সফর এবং চলমান পরমাণু আলোচনার আড়ালে, এক ধরনের অঘোষিত হুমকি ও প্রতিশোধ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
ইরান পরমাণু ইস্যুতে নমনীয় না হলে, ইসরায়েল যে ট্রাম্পের নির্দেশ ছাড়াও নিজের মতো করে কঠোর পদক্ষেপ নেবে—সে ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল দেশটির গোয়েন্দা ও প্রতিরক্ষা মহল।
রাশিয়ার প্রভাবশালী সামরিক কর্মকর্তা, ৫১ বছর বয়সী আপতি আলাদিনোভ, এক টেলিগ্রাম পোস্টে সরাসরি বলেছেন—“এই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এটা শুধু ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ নয়, বরং এটি বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর মুখোমুখি অবস্থানের সূচনা।” তিনি রাশিয়ার জন্য নতুন করে সেনা প্রস্তুতির কথা বলেন এবং জানান, “বর্তমানে অন্তত পাঁচ লাখ সৈন্য প্রস্তুত করতে হবে, তবে বাস্তবে প্রয়োজন এক মিলিয়ন।”
তিনি আরও বলেন, “পশ্চিমারা যেভাবে অন্যদের সঙ্গে খেলে, এখন তারা ইরানের সঙ্গে খেলছে। আমাদের (রাশিয়ার) সাথেও যেন এমন কিছু করার সাহস না পায়, সে কারণেই এখন থেকেই যুদ্ধ প্রস্তুতি জরুরি।”
আলাদিনোভের এই বক্তব্য শুধু রাশিয়ার নয়, বরং পুরো ইউরেশিয়া অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
ইসরায়েলের আগ্রাসনের জবাবে ইরানও বসে থাকেনি। পরদিন শনিবার, দেশটি একের পর এক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েলের বেশ কিছু সামরিক ও বেসামরিক এলাকায়। এই হামলার ভয়াবহতায় ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাময়িকভাবে ভেঙে পড়ে। রাজধানী তেলআবিব ও হাইফায় আতঙ্ক, বিস্ফোরণ ও ধ্বংসের চিত্র উঠে এসেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে।
এই যুদ্ধের অভিঘাত আন্তর্জাতিক বাজারেও পড়তে শুরু করেছে। তেলের দাম লাফিয়ে বেড়েছে, সোনার দাম নতুন রেকর্ড স্পর্শ করেছে এবং শেয়ারবাজারে অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও চীন ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, তবে এখনো পর্যন্ত একটি কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এক জরুরি বৈঠকের আহ্বান করা হলেও সদস্য দেশগুলোর মতপার্থক্যে তা ফলপ্রসূ হয়নি। এমন অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য জ্বলতে থাকলে, তার আগুনে পুড়তে পারে পুরো পৃথিবী—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন জাতিসংঘ মহাসচিবের এক উপদেষ্টা।
এই মুহূর্তে বিশ্বের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এই সংঘাত কি এখানেই থেমে যাবে, নাকি আরও বড় যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাবে মানবজাতি? ইরান ও ইসরায়েল উভয়েই আপসহীন অবস্থানে। একদিকে পরমাণু সমঝোতা, অন্যদিকে আঞ্চলিক আধিপত্য—সব মিলিয়ে একটি মারাত্মক সমীকরণ তৈরি হয়েছে, যেখানে কূটনীতির চেয়ে শক্তির ভাষা বড় হয়ে উঠছে।
এই সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক মহলকে এখনই কার্যকর, নিরপেক্ষ ও সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুবা ইতিহাস আবারও সেই নির্মম পুনরাবৃত্তির দিকে এগিয়ে যাবে—যেখানে যুদ্ধ শুধু রাষ্ট্রের হয় না, হয় মানবতার বিরুদ্ধে।