
মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ যুগ যুগ ধরে মানবিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সামাজিক সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেখানে বয়সে বড়দের প্রতি সম্মান, শিক্ষক-আলেম-বরিষ্ঠ নাগরিকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং প্রতিবেশীদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক সামাজিক রীতি। গ্রামের মানুষ একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতো, বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করত পাড়ার মাতব্বর কিংবা মসজিদের ইমাম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আজ সেই শ্রদ্ধা ও সম্মানের ভিত্তি কি আগের মতোই দৃঢ় আছে?
আজকের এই আধুনিকতা ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমরা একদিকে যেমন গ্রামীণ সমাজে বিদ্যুতের আলো, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছি, অন্যদিকে সমাজের সেই প্রাচীন ও মৌলিক মূল্যবোধগুলো ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি। এখন আর ছোটরা বড়দের সামনে মাথা নিচু করে কথা বলে না, শিক্ষক বা মুরব্বিদের সাথে কথা বলার ভঙ্গিতে বিনয়ের ছাপ অনেক সময় অনুপস্থিত। এই পরিবর্তন শুধু আচরণগত নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি।
শ্রদ্ধা ও সম্মান কেবল কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একটি মানসিকতা। এটি আত্মিক সম্পর্ককে দৃঢ় করে, সমাজকে বন্ধনবদ্ধ রাখে। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ কৃষক, যিনি তার অভিজ্ঞতা দিয়ে পুরো গ্রামকে পথ দেখিয়েছেন, তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে কেমন হওয়া উচিত—এ প্রশ্ন আমাদের আত্মার গভীরে নাড়া দেয়। যখন আমরা শুনি, গ্রামের কোনো প্রবীণকে অবহেলা করা হয়েছে, কিংবা কোনো মুরব্বিকে ঠুনকো কারণে অপমানিত হতে হয়েছে, তখন মনে হয়—আমরা আসলে কতটা পিছিয়ে যাচ্ছি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থের অহঙ্কার, কিংবা শহুরে জীবনের চটকদার সংস্কৃতি অনেক সময় গ্রামীণ সমাজে এমন এক ধরণের মনোভাব তৈরি করছে যেখানে ‘মর্যাদা’ আর ‘মুনাফা’র পার্থক্য ধোঁয়াশায় পড়ে যাচ্ছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি, একজন মানুষ যতই আধুনিক হোক না কেন, তার নৈতিক ভিত্তি যদি দুর্বল হয়, তবে সেই উন্নয়ন অন্তঃসারশূন্য।
এই অবস্থার উত্তরণে সবচেয়ে জরুরি হল পরিবারে মূল্যবোধ শিক্ষা দেওয়া, স্কুলে মানবিকতা ও নৈতিকতা বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা, এবং সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি করা। ইমাম, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের উচিত প্রতিনিয়ত সমাজকে সেই পুরোনো অথচ প্রয়োজনীয় মূল্যবোধের দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা।
আমরা চাই, গ্রাম হোক প্রযুক্তিতে আধুনিক, কিন্তু তার আত্মা হোক আদর্শে প্রাচীন। যেখানে শিশুরা শিখবে, “যে বড় তাকে সম্মান করো, এবং যে ছোট তাকে স্নেহ দাও”—এই শিক্ষাটুকু।
শ্রদ্ধা ও সম্মান শুধু একটি সমাজের সৌন্দর্য নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়।