
মোঃ শাহজাহান বাশার ,স্টাফ রিপোর্টার
দেশজুড়ে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান, যৌথবাহিনীর টাস্কফোর্স অভিযান এবং সাম্প্রতিক ‘অপারেশন ডেভিল হ্যান্ড’— সবকিছু মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলেও, গাজীপুরের টঙ্গীর কুখ্যাত মাদক সম্রাজ্ঞী আরফিনা আজও রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
স্বৈরাচার সরকারের আমল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনকালেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠে আরফিনার এই অপরাধ সাম্রাজ্য। বিশেষ করে গাজীপুর-২ আসনের সাবেক এমপির চাচা মতিউর রহমান মতি ছিলেন তার অন্যতম রক্ষাকর্তা। বিনিময়ে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন তিনি এবং তার আশপাশের লোকজন।
টঙ্গীর ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকের মাঠ এলাকার ক্যাপ্রি সিনেমা হলসহ আশপাশের বেশ কিছু জমি ১৬ বছর ধরে মতির দখলে থাকলেও, মূলত এই জমিগুলোকে কেন্দ্র করেই আরফিনার মাদকের কারবার বিস্তার লাভ করে। মতির পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে টঙ্গীর মাদক সাম্রাজ্য, যার নেতৃত্বে ছিলো আরফিনা।
২০০৬ সালে স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর মতিউর রহমান মতি আত্মগোপনে চলে গেলে, সেই জমিগুলো সরকারি মালিকানায় ফেরত আসে। তখন কিছুদিন গা ঢাকা দিলেও, পরবর্তীতে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী বিএনপি নেতার ছত্রছায়ায় আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন আরফিনা। নতুন শেল্টারে আরও শক্তিশালী হয়ে ফেরত আসে তার মাদকের ব্যবসা।
প্রশাসনের নিরব ভূমিকা ও ‘গডফাদার’ সিস্টেম
দৈনিক সবুজ বাংলাদেশ পত্রিকায় একাধিকবার আরফিনার মাদক সাম্রাজ্য নিয়ে প্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও, প্রশাসন বরাবরই থেকেছে নিরব। সর্বশেষ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে, টঙ্গীর ব্যাংকের মাঠ বস্তিতে র্যাব-১ পরিচালিত ‘অপারেশন ডেভিল হ্যান্ড’ অভিযানে ১,৭৫১ বোতল ফেনসিডিলসহ ৬ জন মাদক কারবারি আটক হয়।
তদন্তে উঠে আসে, জব্দ করা অধিকাংশ ফেনসিডিলের মালিক ছিলেন মাদক সম্রাজ্ঞী আরফিনা। কিন্তু তাকে ধরার পরিবর্তে, কিছু অসাধু প্রশাসনিক কর্মকর্তার সহায়তায় আগেভাগেই এলাকা ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। মামলা হলেও আরফিনাকে রাখা হয় মামলার ৯ নম্বর আসামি হিসেবে, যা ছিলো একটি ‘সেফ পজিশন’। পরে মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে হাইকোর্ট থেকে অগ্রিম জামিন নিয়ে আবারও আড়ালে চলে যান তিনি।
এদিকে, গ্রেপ্তার হওয়া ৬ জন কথিত মাদক কারবারি এখন জেল খাটছে নীরবে। অন্যদিকে, আরফিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী দেওড়া আক্তার ও জাল সালমা এখনও প্রকাশ্যে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছে।
মাদক সাম্রাজ্যের মাস্টারমাইন্ড ও মাসোহারা সিন্ডিকেট
বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, মাদক সম্রাজ্যের পুরো নেটওয়ার্ক চালাতে আরফিনা এখনো প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের মাসোহারা পৌঁছে দেন স্থানীয় কিছু নেতার হাতে, সঙ্গে প্রশাসনের একাংশকেও। সেই অর্থের জোরেই, বারবার অভিযানের আগেই সতর্ক হয়ে যান তিনি।
সচেতন মহলের উদ্বেগ টঙ্গীর স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই বলছেন, প্রশাসনের এই নির্লজ্জ নীরবতাই মাদক সম্রাজ্য রক্ষা করার মূল অস্ত্র। তারা বলেন, “এভাবে যদি মাদকদ্রব্য প্রকাশ্যে বিক্রি হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কী হবে? প্রশাসনের নিরবতায় আজ টঙ্গীর বুকে মাদক সম্রাজ্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।”
প্রশাসনের ভাষ্য এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ দক্ষিণ) দৈনিক সবুজ বাংলাদেশকে বলেন, “আমরা নিয়মিত বস্তি এলাকাগুলোতে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছি এবং মাদকের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দিচ্ছি।”
তবে, টঙ্গীবাসীর অভিযোগ— অভিযানের এই লোকদেখানো পর্বেই সীমাবদ্ধ থাকছে প্রশাসনের ভূমিকা। আর এই ফাঁকেই বুক চিতিয়ে মাদকের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন আরফিনা ও তার চক্র।