অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের সময় লোহিত সাগরে একের পর এক হামলার সময় বিশ্বজুড়ে মালবাহী সরবরাহ শৃঙ্খলে বিশৃঙ্খল তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়ায় রফতানিকারকরা বিকল্প বিমান, স্থল ও সমুদ্রপথ খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছেন।
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ৭৬ দিনের ইসরায়েলি আগ্রাসন ও অবরোধ সহ্য করে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানাতে গত ১৯ নভেম্বর থেকে লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা বাড়িয়েছে।
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের আক্রমণের কারণে লোহিত সাগর ব্যবহার করছে না জাহাজ সংস্থাগুলো। যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হামাসকে সর্মথন জানিয়ে ইয়েমেন উপকূলে গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লেনের জাহাজগুলোতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে ইরান-সর্মথিত হুথিরা।
চলতি মাসেও ইয়েমেনের কাছে লোহিত সাগরে বেশ কয়েকটি পণ্যবাহী জাহাজের ওপর আক্রমণ চালায় হুতিরা। এরপরেই অধিকাংশ বাণিজ্যিক জাহাজ সংস্থা ঠিক করে, তারা লোহিত সাগরের রাস্তা এড়িয়ে অন্য পথ নেবে।
এশিয়া থেকে ইউরোপের পথে লোহিত সাগর হলো সবচেয়ে সহজ রাস্তা। লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে সুয়েজ খাল ধরে যায় এই রাস্তা। এই রাস্তা এড়াতে হলে আফ্রিকায় ঢুকতে হবে। আফ্রিকার সেই ঘুরপথেই আপাতত চলাচল করছে অধিকাংশ পণ্যবাহী জাহাজ।
এর ফলে জাহাজগুলোর চলাচলের সময় অন্তত এক সপ্তাহ বেড়ে গেছে। যেতে হচ্ছে অতিরিক্ত সাড়ে ৩ হাজার নটিকাল মাইল।এর ফলে জাহাজ চলাচলের খরচ অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে।
বস্তুত, সুয়েজ খাল দিয়ে বিশ্বের ১২ শতাংশ বাণিজ্য সঞ্চালিত হয়। সেই ব্যস্ত রাস্তা এখন কার্যত খালি।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসের দাম ভয়ংকরভাবে বেড়ে যাবে। সাংহাই থেকে রোটারডাম যদি কেপ অফ গুড হোপ হয়ে যেতে হয়, তাহলে জাহাজের তেলের দামই এক মিলিয়ন ডলার বেশি পড়ে। পণ্য সংস্থাগুলো স্বাভাবিকভাবেই সেই ক্ষতি নিজেদের কাঁধে রাখবে না। তারা পণ্যের উপর সেই দাম ধার্য করবে। ফলে জিনিসের দাম ইতিমধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে।
শুধু তাই নয়, এই পথে যাত্রা করা জাহাজগুলোর বিমার মূল্যও অনেকগুণ বেড়ে গেছে। কোপেনহাগেনের একটি সংস্থার বাজার বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, ‘জাহাজের এই অন্য রাস্তা নেয়া আন্তর্জাতিক বাজারে ইতিমধ্যেই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।’
সমস্যা হচ্ছে অন্য দিকেও। ইউরোপের বন্দরগুলোতে নির্দিষ্ট কাজের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ লোক আছে। ধরা যাক একটি বন্দর সপ্তাহে ৫০ হাজার কনটেনার নামাতে অভ্যস্ত। সেখানে আচমকাই দেখা গেল এক সপ্তাহে কনটেনার আসছে না, পরের সপ্তাহে দ্বিগুণ কনটেনার আসছে। তখন কাজের ভারসাম্য নষ্ট যায়। জাহাজগুলো সুয়েজ খাল এড়িয়ে চলার ফলে বর্তমানে ঠিক সেই ঘটনাই ঘটছে। বন্দরগুলোতে ভয়াবহ চাপ বেড়ে গেছে। যা সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
কোভিডের সময় একবার কিছুদিনের জন্য সুয়েজ খাল বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সে সময় গোটা বিশ্বে দ্রব্যমূল্য আচমকাই অনেকটা বেড়ে গেছিল। ফের তেমনই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
যদিও গত সোমবারই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন জানিয়েছেন, লোহিত সাগরের জন্য ১০ দেশের সমন্বয়ে একটি নতুন প্রতিরক্ষা বাহিনী তৈরি করা হচ্ছে। পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে হুতি আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করবে তারা। তবে হুতিরা হুশিয়ারি দিয়েছে তারা জাহাজে আক্রমণ অব্যাহত রাখবে। আর জাহাজ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, সম্পূর্ণ নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত তারা লোহিত সাগর এড়িয়ে চলবে।