নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার কালীগঞ্জ এলাকার লিখন হোসেন। দাদির চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গত ৩০ আগস্ট পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিলেন জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। গ্রামের নাম ভুল দেখিয়ে তার আবেদনটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
দুদিন সরকারি ছুটি থাকায় রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) পাসপোর্ট অফিসের শনাক্ত করা ভুল সংশোধন করে আবার আবেদন জমা দেন লিখন। তবে কারণ ছাড়াই ফের আবেদনটি নাকচ করেন দায়িত্বরত কর্মকর্তা। দ্বিতীয়বার আবেদন নাকচ হওয়ার পর লিখনকে পাসপোর্টের আবেদন পাস করিয়ে দেওয়ার কথা বলেন আল আমিন নামে একজন। তিনি জানান, দেড় হাজার টাকা অতিরিক্তc আবেদন পাস করিয়ে দেওয়া হবে। পাসপোর্ট তৈরি জরুরি হওয়ায় আল আমিনকে দেড় হাজার টাকা দেন লিখন।
তার মাত্র ১০ মিনিটের মাথায় কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই সরাসরি আঙুলের ছাপ নেওয়া হয় লিখনের। পরে তাৎক্ষণিক সম্পন্ন করা হয় বাকি প্রক্রিয়া। মাত্র ৩০ মিনিটে লিখনের হাতে আসে পাসপোর্ট ডেলিভারি স্লিপ।
লিখন হোসেন বলেন, প্রথমদিন তারা আমার গ্রামের নাম ভুল দেখিয়ে ঠিক করে নিয়ে আসতে বলেন। তাদের দেখানো ভুল ঠিক করে আনলে কোনো কারণ ছাড়াই আবারও ভুল দেখানো হয়। পরে সেই কাগজ কোনো সংশোধন ছাড়াই দালালের মাধ্যমে গ্রহণ করে অফিস। এখন আমার প্রশ্ন হলো, তারা বারবার ভুল দেখিয়ে কি আমাদের দালালের শরণাপন্ন হতে বাধ্য করছে? এমন ভোগান্তির মানে কী?
এ বিষয়ে লিখনের কাছে টাকা নেওয়া দালাল আল আমিনের কাছে জানতে চাইলে পাসপোর্ট তৈরির জন্য নেওয়া অতিরিক্ত দেড় হাজার টাকা ফেরত দিয়ে দৌড়ে পালান তিনি। পরে ফোন করা হলে তিনি জানান, অফিসের লোকজনের সহযোগিতায় পাসপোর্ট তৈরি করে দেন তারা।
আল আমিনের মতো এমন দালাল আরও অন্তত ডজনখানেক আছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়। এই চক্র মিলে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের জোগসাজশে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে কাজ করে দেন। টাকা দিলে মুহূর্তে সব সমস্যার সমাধান মেলে। ভিতর থেকে ভুল বলবে আর বাইরে এলেই তারা ঠিক করে দেওয়ার নাম করে নিচ্ছেন টাকা। এভাবে তারা টাকা ‘হালাল’ করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু লিখন ইসলাম নন, এমন ভোগান্তির শিকার ওই পাসপোর্ট অফিসে আসা প্রায় সব আবেদনকারী। আবেদনে বারবার ভুল দেখিয়ে পাসপোর্টপ্রত্যাশীদের বাধ্য করা হয় দালালের শরণাপন্ন হতে। পরে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ একটি দালালচক্র পাসপোর্টপ্রত্যাশীদের টার্গেট করে। চক্রের সদস্যদের ভুলের ধরন অনুযায়ী দেড় থেকে তিন হাজার টাকা দিলেই দালাল নিজেই আবেদন ফরম নিয়ে যান আঙুলের ছাপের জন্য। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই এক ঘণ্টার মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের ভুল চিহ্নিত আবেদন ফরমের মাধ্যমেই শেষ করা হয় সব প্রক্রিয়া।
নীলফামারী থেকে পাসপোর্ট করান মালয়েশিয়া প্রবাসী শাখাওয়াত হোসেন সবুজ। পাসপোর্ট অফিসের হয়রানির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাসপোর্টের আবেদনে সব ঠিক থাকার পরও আমাকে বারবার ঘোরানো হয়েছে। আমি শেষে বাধ্য হয়ে ওখানকার এক দালালের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা দিয়ে পাসপোর্ট করি। কারণ, আমার বিদেশে আসা জরুরি ছিল। দুই মাস আগে আমি মালয়েশিয়া আসি।
ইয়াসিন আলী নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, আমাকে পাসপোর্ট অফিস থেকে জানানো হয় আবেদনে ভুল হয়েছে। প্রথমবার ভুল সংশোধন করলে দ্বিতীয়বার আবারও ভুল দেখানো হয়। সে ভুল ঠিক করার পরও চারবার আমার আবেদন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে কী ভুল আছে নির্দিষ্ট করে তারা জানায় না। দালালরা এসে পাসপোর্ট করার প্রস্তাব দিলেও মনের দুঃখে আর পাসপোর্ট করিনি। বলতে পারেন আমাকে আমার নাগরিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত করেছে।
লিমন ইসলাম নামে একজন বলেন, আমার পাসপোর্ট করতে গিয়েও ভোগান্তি হয়েছে। বাধ্য হয়ে আমাকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়েছিল। ওখানে আসলে কিছু করার থাকে না। কারণ, সবাই জরুরি কাজের জন্যই পাসপোর্ট করতে আসেন।
এ বিষয়ে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। অফিস সময়ের মধ্যে আর ফিরে আসেননি। পরে কয়েকদিনে একাধিক নম্বর থেকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। অফিস সময়ের মধ্যে আর ফিরে আসেননি। পরে কয়েকদিনে একাধিক নম্বর থেকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও রিসিভ করেননি।
সবশেষ পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী পরিচয় দেওয়া পরিচ্ছন্নতাকর্মী রোমিও দাস প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। তিনিই এ দালাল সিন্ডিকেটের মূল হোতা বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে মোবাইলে রোমিও দাসের কাছে জানতে চাইলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরে সাক্ষাতে কথা বলবো বলে ফোন কেটে দেন।
জাগো নিউজ