রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত ও নির্বাচনী পরিবেশ 

গাজী জাহাঙ্গীর আলম জাবির

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির।।

              ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গত ১৫ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তফসিল ঘোষণা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা এবং কাউন্ট-ডাউন পর্ব। পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতি এখন সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দল পরস্পর-বিরোধী অবস্থানে আছেন। সরকারি দল বলছে সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সুযোগ নেই।  সংলাপ-সমঝোতার পরিবর্তে রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক- সংঘাত ও নৈরাজ্যের পথে রাজনৈতিক দলের অবস্থান । এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, দেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন কোন পথে যাচ্ছে। সাধারণত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে কোনো বিরোধ কিংবা অনিশ্চয়তা কাটানোর প্রধান পথ হলো আলাপ-আলোচনা। দুই পক্ষের অনড় অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই জনগণকে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। জনগণ চায়, শান্তিপূর্ণ,অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ  নির্বাচন। এক্ষেত্রে আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের বিকল্প নেই। উভয় দল অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করার পরিবেশ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। সরকারি দল ও বিরোধী দলের নমনীয়

অবস্থানই দেশকে সম্পূর্ণভাবে নির্বাচনমুখী করে তুলতে পারে।

বিএনপি সমর্থকদের কাছে অত্যন্ত নিষ্ঠুর শোনালেও আপাতত একটা জনশ্রুতি রয়েছে, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে হয়তো আওয়ামী লীগই আবার সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। এর কারণ বিএনপির যে একদফা দাবি তা পূরণ করার সদিচ্ছা সরকারের নেই এবং সেটা যদি না ঘটে, বিএনপি বাধ্য করবে সরকারকে পদত্যাগে এমন পূর্বাভাসও দেখা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ কর্মীরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তারা আবারও ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে। এমন  পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করবে? বিএনপির কি ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা রয়েছে? এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে কোনো পরিস্থিতি আঁচ করা যাচ্ছে না এই মুহূর্তে।

বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের শেষ সময়ে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন প্রশ্নে সংকট স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। ‘৯০-পরবর্তী প্রায় প্রতিটি সরকার শেষেই নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দেশে সংঘাত ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। কখনো সংকট থেকে সুষ্ঠু উত্তরণ ঘটেছে, আবার কখনো রাজনৈতিক ঘোলাটে পরিবেশ বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বিএনপির এমন রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে ভুল রাজনীতির শামিল। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র সাংবিধানিক পদ্ধতি হিসেবে নির্বাচনের বিকল্প নেই। আর এই তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের ইতিবাচক যাত্রাকে স্বাগত জানানোই সবার জন্য

মঙ্গলজনক মনে করা আপাতত দৃষ্টিতে ভুল মনে হচ্ছে না। বাদ বাকি ভরসার জায়গা দেশের রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ কি চান তাঁর উপর নির্ভর করবে। দেশের গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত থাকুক এটা শান্তি প্রিয় জনগণের চাওয়া।  সাধারণ মানুষ চায় , হরতাল-অবরোধের নামে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ  এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক অঙ্গীকার।

বাংলাদেশে নির্বাচনের উদ্দেশ্য হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পুনঃপ্রবর্তন। কারণ গণতন্ত্র আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যে কোনো মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।” সত্যিকারের গণতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক শাসনের কার্যকারিতা বহুলাংশে নির্ভর করে সরকারের আচরণ ও কার্যক্রমের ওপর। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের দায়িত্বও কম নয়।

তফসিল ঘোষণার পরও বিরোধী দলের

অবরোধের কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এমনকি দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা এবং বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটে চলেছে। বিরোধী দলের নাশকতা, তাণ্ডব এবং সহিংসতার ঘটনা এক ভীতিকর

পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। এমুহুর্তে সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দদের সদিচ্ছা নিয়ে  আলোচনার পরিবেশ তৈরি করে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অর্থবহ করা। আমার এই  ধারণা বা সম্ভাবনা  বেশি নয়।সব দলের আন্তরিক ইচ্ছাই যথেষ্ট মনে করছি। 

এদিকে সরকারি দলসহ  বেশকিছু রাজনৈতিক দল মনোনয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সময় খুবই কম। সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচনকে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ হিসেবে বিবেচনা করার কথা থাকলেও দেশে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই চলছে আতঙ্ক এবং উৎকণ্ঠার মধ্যদিয়ে। 

কারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং না করাকে কেন্দ্র করে দু’টি পারস্পরিক বিরোধী বলয় তৈরি হয়েছে। আর এই বলয়ের গ্যাঁড়াকলে বাংলাদেশ এখন নানাবিধ নাটকীয়তার মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ বিরোধী দল উভয়কেই নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে লড়াই করতে হয়। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে, রাজনৈতিক অস্থিরতাকে তুঙ্গে তুলে, ঘন ঘন

সংগ্রামের ফসল গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব জনগণ, সরকার এবং বিরোধী দলের।এক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করতে হবে। হরতাল কিংবা অবরোধ ডেকে  সহিংসতা ও ভাংচুর করে অগণতান্ত্রিক কোনো পন্থায় সরকার পরিবর্তনের প্রয়াস গণতন্ত্রের পরিপন্থি। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকামী সত্যিকারে দেশের রাজনীতিবিদরা কি চান যে দেশের গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত থাকুক? এখন সাধারণ মানুষের মনে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সংঘাত তথা অসুস্থ অগণতান্ত্রিক সংঘাত, শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার বারবার গণতন্ত্রকে হটিয়ে দেবার মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্রকে সাহায্য করেছে। এমনকি ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির উদ্ভব ও বিকাশের সহায়ক হয়েছে।

নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে কোনো নৈরাজ্য কিংবা নাশকতা না করার প্রতিশ্রুতি জনগণ আশা করে। গণতন্ত্র হলো পরমতসহিষ্ণুতা। তাই দেশের স্বার্থে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সুসংহত করতে সব রাজনৈতিক দলের একটি ঐকমত্যের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো উচিত। সবশেষে বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এমন কর্মসূচি কিংবা সিদ্ধান্ত রাজনীতিতে চরম বুমেরাং হবে- যার মাশুল দেশের প্রতিটি মানুষকে দিতে হতে পারে। আর এর জন্য সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বের ব্যর্থতাই দায়ী থাকবে। কাজেই নির্বাচনের তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্ল্যাটফর্ম তৈরিই অধিকতর শ্রেয় বলে মনে হয়।

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্ম ও সমাজ সচেতন লেখক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক ও চেয়ারম্যান, গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা।