মব ভায়োলেন্স: হিংস্রতার উন্মত্ততায় মানবতা আজ পরাজিত

মোঃ শাহজাহান বাশার
কলামিস্ট ও স্টাফ রিপোর্টার

বর্তমান বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘মব ভায়োলেন্স’ বা গণপিটুনির সংস্কৃতি। কোনো সত্যতা যাচাই না করেই একজন মানুষকে ঘিরে ধরে উত্তেজিত জনতা, তার দিকে ছুটে যায় লাঠিসোঁটা হাতে, মুহূর্তেই চলে মারধর, এবং কখনো কখনো চলে নির্মম হত্যাকাণ্ড। আধুনিক সভ্যতায় দাঁড়িয়ে এমন ঘটনা শুধু লজ্জার নয়, এটি মানবতার চরম অবনমন ও সমাজের মূল্যবোধের বিপর্যয়ের প্রতীক।

মানুষ যেন হয়ে উঠছে হিংস্র জানোয়ারের চেয়েও ভয়ংকর! একসময় আমরা জানতাম, হিংস্র প্রাণীরা আক্রমণ করে খাদ্যের প্রয়োজনে বা আত্মরক্ষার্থে। কিন্তু আজকের এই তথাকথিত ‘সভ্য’ সমাজে মানুষ হত্যা করা হয় সন্দেহের বশে, সামান্য গুজবের ভিত্তিতে কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উসকানিতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ‘চোর’, ‘ডাকাত’, ‘শিশু চোর’ কিংবা ‘ধর্ম অবমাননাকারী’ বলে একজন নিরীহ মানুষকে জনতার রোষানলে ফেলে দেওয়া হয়। বিচার তো দূরের কথা, কেউ মুখ খুলে তার পক্ষেও দাঁড়াতে সাহস করে না।

গণপিটুনি মূলত বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা ও আইন-শৃঙ্খলার অভাব থেকেই জন্ম নেয়। যখন মানুষ দেখে অপরাধীরা বিচারের আওতায় আসে না, তখন তারা নিজেরাই ‘বিচারক’ হওয়ার ভান করে। কিন্তু এটি কোনো সমাধান নয়; বরং এটি এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, যেখানে আজ একজন নির্দোষ মারা গেল, কাল তার স্থান নিতে পারে আপনিও!

এই হিংস্রতার সংস্কৃতি রুখতে হবে এখনই, মব ভায়োলেন্স শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতিই করে না, এটি গোটা সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলে। এর ফলে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়, সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট হয়, এবং দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পরিসরে কলঙ্কিত হয়।

তাই এখনই সময়— মানুষকে সচেতন করার,আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা রুখে দেওয়ার, মিথ্যা গুজব ছড়ানো অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার,এবং সর্বোপরি— বিচারিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনার।

সরকার, প্রশাসন ও সমাজের প্রতি আহ্বান,আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই— প্রতিটি মব ভায়োলেন্সের ঘটনার দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত হোক। দোষীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।যারা মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা উসকে দেয়, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। স্কুল-কলেজ-মসজিদসহ সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু হোক।

আমাদেরও দায়িত্ব আছে,এই সমাজে আমরা প্রত্যেকেই বাস করি, তাই আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব আছে মানবতা রক্ষা করার। কারো ওপর হামলার আগে অন্তত একবার ভাবুন— যদি সে আপনার ভাই হতো? আপনার সন্তান হতো? আপনার বাবা হতো? এই একবারের বিবেচনাই হয়তো কাউকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারত।

মব ভায়োলেন্সে আজ মানুষ অসহায়। সামাজিক বিবেক যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। হিংস্রতার উন্মত্ততায় আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলছি।
এখনই সময়— ‘গণপিটুনি’ নয়, আইনের আশ্রয় নিন। হিংস্রতা নয়, মানবতার জয় হোক। মব ভায়োলেন্স বন্ধ হোক! মানুষ আবার মানুষ হয়ে উঠুক!