
মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার*
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ ও ছাত্রদের ওপর চালানো হামলা, গুলি ও গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই মামলায় প্রধান অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, এবং তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
রবিবার (১ জুন) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার-এর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আদেশ দেন। আদালত শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামালের বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন এবং অপর আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে এই মামলায় ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ হিসেবে দেখাতে আদেশ দিয়েছেন।
গত ১ জুন সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই মামলার অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয় এবং এ বিচারপ্রক্রিয়া বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। বিচার সংশ্লিষ্টরা একে বলছেন ‘ঐতিহাসিক ও নজিরবিহীন একটি বিচারিক অধ্যায়।’
এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। তারা উল্লেখ করে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সরকারবিরোধী ছাত্র ও জনসাধারণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গণহত্যা চালায়। এতে প্রাণ হারায় প্রায় দেড় হাজার মানুষ, যার বেশিরভাগই ছিল তরুণ ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী।
গত ১২ মে তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনা ছিলেন এই মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘প্রধান নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী’। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আইজিপি হিসেবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সরাসরি এই নির্মম অভিযান বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল এই মামলার তদন্ত ২০ এপ্রিলের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছিল। তারও আগে, ২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে আরও দুই মামলার তদন্ত দুই মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দেন আদালত।
আদালতে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করেন অতিরিক্ত চিফ প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। তিনি শুনানিতে বলেন,“নিরস্ত্র ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ওপর যেভাবে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যার স্পষ্ট সংজ্ঞায় পড়ে। আদালতের এই সিদ্ধান্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে একটি নজির স্থাপন করল।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে মানবাধিকার ও বিচারিক জবাবদিহির যে নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, এই মামলাটি তারই অংশ। একটি সরকারকে ক্ষমতা হারানোর পর তার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার শুরু হওয়া বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
এই মামলার কার্যক্রম এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একদল বলছে, “বিচার হচ্ছে, ইতিহাসের দায় মেটানো হচ্ছে।” আর অন্যদল বলছে, “এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা।”
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই বিচার শুধু ব্যক্তি শেখ হাসিনার নয়, বরং এক যুগব্যাপী ক্ষমতাকেন্দ্রিক শাসনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদালত তার রায়ে যা বলেছে—সেটি স্পষ্টতই ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় উন্মোচনের ইঙ্গিত বহন করে।
এই মামলা ও বিচারিক কার্যক্রমের পরিণতি কী হবে তা এখন সময়ই বলবে। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের বিচার ও রাজনীতিতে এটি একটি যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে থাকবে।