প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শালিক পাখি: গ্রামীণ জনপদে নেই আগের সেই দৃশ্য

মো. শাহজাহান বাশার,স্টাফ রিপোর্টার

এক সময় বাংলার গ্রামীণ জনপদে সকাল-সন্ধ্যায় শোনা যেত শালিক পাখির কিচিরমিচির সুর। ধানক্ষেত, বাঁশঝাড় কিংবা বাড়ির আঙিনায় ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াতো পরিচিত এই পাখিগুলো। কিন্তু কালের বিবর্তনে ও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার কারণে বারহাট্টাসহ সারা বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে দ্রুতই হারিয়ে যাচ্ছে নিরীহ স্বভাবের শালিক পাখি।

প্রখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশের “আবার আসিব ফিরে” কবিতায় উল্লেখিত শালিক আজ যেন বাস্তবেই হয়ে উঠেছে দুর্লভ। ধূসর রঙের ছোট এই পাখিটি মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে ভালবাসে। কিন্তু আজ আর গ্রামের মানুষের ভোর ভাঙে না শালিকের কণ্ঠে। নির্জন হয়ে পড়েছে বনের প্রান্ত, ফসলি মাঠ ও বাঁশঝাড়।

বারহাট্টা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এক সময়ের পরিচিত দৃশ্যটি এখন শুধুই স্মৃতি। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে বাড়ির পাশে, ক্ষেত-খামারে, বাঁশঝাড়ে নিয়মিত দেখা যেত শালিক পাখি। এখন তা প্রায় বিলুপ্তির পথে।

কৃষক তপন সরকার, নিজাম উদ্দিন, আলাল মিয়া ও কুতুব উদ্দিন জানান, শালিক পাখি কৃষির সহায়ক ছিল। তারা ক্ষতিকর পোকা-মাকড় খেয়ে ফসল রক্ষা করতো। কিন্তু বর্তমানে কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার এবং পরিবেশদূষণের ফলে শালিক পাখির উপস্থিতি কমে গেছে। বিষ ছাড়া এখন ফসল উৎপাদন করা কঠিন, তাই বাধ্য হয়েই তারা বিষ ব্যবহার করেন।

এ প্রসঙ্গে বারহাট্টা সরকারি ডিগ্রি কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র প্রভাষক মজিবুল হক বলেন, “শালিকের বৈজ্ঞানিক নাম Acridotheres tristis, ইংরেজি নাম Common myna। এদের অনেক প্রজাতি থাকলেও বর্তমানে ভাত শালিক ও গোবর শালিক ছাড়া অন্য কোনো প্রজাতির শালিক দেখা দুষ্কর।” তিনি জানান, শালিকের খাদ্য তালিকায় রয়েছে শস্য, ফলমূল ও পোকামাকড়। শব্দ অনুকরণে পারদর্শী এ পাখির ডাক বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয়।

তিনি আরও জানান, আমাদের অঞ্চলে পাওয়া যায় ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, গাঙ শালিক, বামন শালিক, চিত্রা শালিক, গোলাপী শালিক, কাঠ শালিক এবং ময়না। কিন্তু প্রতিটি প্রজাতির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

বারহাট্টা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কালের কণ্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক ফেরদৌস আহমেদ বলেন, “যান্ত্রিক সভ্যতা, বনভূমি উজাড়, বৃক্ষনিধন এবং পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড শালিকসহ দেশীয় পাখিদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছে। শিশুদের আর এখন প্রকৃতির সান্নিধ্যে পাখি চিনিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।”

এ বিষয়ে বারহাট্টা উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মানিক আজাদ বলেন, “শালিকসহ দেশীয় পাখিগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এগুলো রক্ষায় প্রশাসন, পরিবেশবিদ ও সচেতন জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।”

বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়রা মনে করেন, পাখিদের বাঁচাতে হলে কীটনাশকের বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে, বন্ধ করতে হবে অবাধ বৃক্ষনিধন এবং সংরক্ষিত পাখি শিকারের মত কর্মকাণ্ড। না হলে প্রকৃতি থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে এই দেশীয় প্রজাতিগুলো, যা পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।