কুমিল্লায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সবজিখেত
দেশের অন্যতম বৃহৎ কাঁচাবাজার কুমিল্লার নিমসার। কিছুদিন আগে বন্যা ও বৃষ্টির কারণে বাজারে সবজির সরবরাহ কম থাকায় সবজির দাম বেশি। আবাদ মিয়া, খলিলুর রহমান, বিল্লালসহ বিভিন্ন আড়তদার জানান, বন্যাসহ অতিরিক্ত বৃষ্টিতে অনেক এলাকায় সবজিখেত নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় চাহিদা বেশির বিপরীতে বাজারে সরবরাহ কম হওয়ায় দাম বেড়ে গেছে। তবে কয়েক দিন ধরে সরবরাহ বাড়ছে, শিগগিরই দাম কমে যাবে বলে তাঁরা আশাবাদী।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তর কুমিল্লার সহকারী পরিচালক আছাদুল ইসলাম বলেন, ‘কুমিল্লার নিমসার পাইকারি বাজারে আমরা বিশেষ টাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনা করি। গত দুই দিনে নিমসার বাজারে বিক্রির ভাউচার না দেওয়ায় তিনটি সবজি আড়তকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।’
অক্টোবরের তৃতীয় কিংবা কার্তিকের প্রথম সপ্তাহ চলছে। অন্য বছরগুলোতে এই সময়ে খেত ও পাইকারি হাট শীতের আগাম সবজিতে ভরা থাকত। তবে এবার এখনো তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। এমনকি অনেক কৃষককে এখনো শীতের সবজির জন্য খেত প্রস্তুত করতেও দেখা গেছে। আর এর প্রভাব পড়েছে সবজির বাজারে। সরবরাহ কম থাকায় কৃষক পর্যায় থেকে শুরু করে খুচরা পর্যন্ত সব বাজারে সবজির দাম চড়া।
কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এবার বৈরী আবহাওয়ার কারণে সবজি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। কখনো খরা আবার কখনো অতিবৃষ্টির কারণে কয়েক দফা সবজির চারা নষ্ট হয়েছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে সার, কীটনাশক, সেচ ও শ্রমিকের বাড়তি খরচ।
যশোরে কিছু খেত এখনো তৈরি হচ্ছে
যশোরের সাতমাইল বারীনগরের হাট এ অঞ্চলে সবজির বড় বাজার। আশপাশের কয়েক গ্রামের কৃষকেরা এই হাটে তাঁদের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করেন। তাঁদেরই একজন সাতমাইল গ্রামের নুরনবী। গতকাল শনিবার কথা হয় তাঁর সঙ্গে। নুরনবী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এবার দুই বিঘা জমিতে বেগুন, দেড় বিঘা জমিতে মুলা আর আধা বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। অত্যধিক বৃষ্টির (জুলাই মাসে) কারণে দুই দফা এই সবজির চারাগুলো রোপণ করা লেগেছে। প্রথম দফায় প্রায় ৮০ শতাংশ বেগুন, ৬৫ শতাংশ মরিচগাছ এবং শতভাগ মুলাগাছ নষ্ট হয়ে যায়।’
নুরনবী জানান, বারবার সবজির চারা রোপণ করায় গাছ বড় হতে দেরি হয়েছে। ফলন আসতেও দেরি। গতকাল হাটের পাশাপাশি যশোর সদর উপজেলার চূড়ামনকাটি, বারীনগর হৈবতপুর এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সবজির খেত। অনেক খেতে এখনো ফলন নেই। কিছু কিছু খেতে সবজি দেখা গেলেও সংখ্যায় কম। কিছু কিছু খেত প্রস্তুত করতেও দেখা গেছে কৃষককে।
হৈবতপুর গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যে সময়ে জমিতে সবজি থাকার কথা, সেই সময়ে সবজির চাষ শুরু করছি। এত দিন বৃষ্টির কারণে আবাদ করতে পারিনি। দুই মাস ধরে জমি ফেলানো।’
পাশেই জুম্মন আলীর জমি। তিনি বলেন, ‘দেড় বিঘা জমিতে মুলা লাগিয়েছি, প্রথমবার বীজ রোপণের সপ্তাহখানিক পর হাঁটুপানি জমে। এতে প্রথমবার সব মার। দ্বিতীয়বার লাগালাম, সেই বারও বৃষ্টি। পরে লাগানোর পর চারা বাঁচে। সেই মুলা অল্প অল্প করে বাজারে বিক্রি করতিছি।’
যশোর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে যশোরের সাতমাইল-বারীনগর সবজি হাট। বর্তমানে প্রতিদিন হাট বসে। গতকাল বেলা ১০টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, ছয় থেকে সাতটি ট্রাকে সবজি ওঠানোর কাজে ব্যস্ত ব্যাপারী ও শ্রমিকেরা। ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে এই সবজি পাঠানো হচ্ছে।
বারীনগর মোকামে খেতের সবজি বিক্রি করা ডহেরপাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল মোল্লা বলেন, বৃষ্টির কারণে এবার সবজির উৎপাদন কমে গেছে। তবে দাম বেশি পাওয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে যাচ্ছে।
ওই বাজারের ব্যাপারী আতিয়ার রহমান বলেন, প্রায় দেড় মাস ধরে বাজারে সবজির সরবরাহ কম। বছরের এ সময় প্রতি হাট থেকে ৫০-৬০ ট্রাক সবজি দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো। আর এখন যাচ্ছে ১০ থেকে ১২ ট্রাক সবজি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, এ বছর অসময়ে অতিবৃষ্টিতে শীতকালীন আগাম সবজির উৎপাদন ২৫ শতাংশ কমে গেছে। তাতে বাজারে সবজির দাম বাড়তি। তবে দ্রুতই সরবরাহ বাড়বে বলে আশা করা যায়।
যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, জেলায় জুলাই থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ২৭৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে; যা গত বছর ছিল ১৫৭০ মিলিমিটার।
খরা ও অতিবৃষ্টি দুটোতেই ভুগেছে বগুড়ার কৃষক
বগুড়ার মহাস্থান হাটে পাইকারি বাজারে কৃষক পটোল বিক্রি করছে ৪৫ টাকা কেজি দরে। সেই পটোল ওই হাটে খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি। আর ১০ কিলোমিটার দূরে বগুড়া শহরের রাজাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি। শহরের অন্যান্য বাজারে পটোল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি দরে। গতকাল বগুড়ার বৃহৎ পাইকারি সবজির বাজার মহাস্থান হাট ছাড়াও শহরের পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
মহাস্থান হাটে মুলা বিক্রি করতে আসা শিবগঞ্জের কিচক গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, এক সপ্তাহ আগে তিনি মুলা বিক্রি করেছেন ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে। সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কমেছে মণপ্রতি ২০০ টাকা।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবুর রহমান বলেন, এবার ভাদ্র মাসে তাপমাত্রা বেশি এবং কয়েক দফা বৃষ্টির কারণে সবজিখেতের ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে শীতকালীন আগাম সবজি বাজারে আসতে দেরি হয়েছে। এ জন্য সবজির দাম বাজারে বেশি। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে সব ধরনের সবজির দাম কমতে শুরু করবে বলে তিনি আশাবাদী।
পাবনার ঈশ্বরদীতেই শিম ১৩০ টাকা
উত্তরাঞ্চলের সবজির অন্যতম প্রসিদ্ধ মোকাম ও পাইকারি বাজার পাবনার ঈশ্বরদীর মুলাডুলি সবজির আড়ত। এই আড়তে সবজি বিক্রি করতে এসেছেন ঈশ্বরদীর পাশের আটঘরিয়া উপজেলার মথুরানগর গ্রামের কৃষক সুলতান খাঁ। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে থাকা এক আড়তদারের হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। কয়েক সেকেন্ড কথা বলার পর আড়তদার বলেন, ‘কাম হয়্যা গেছে, শিমের দাম তো এইমাত্র বাড়ি (বেড়ে) গেছে, ঢাকা থেকে আমাক এক মহাজন জানালি শিম এখন ১৩০ টাকার পরিবর্তে ১৩৫ টাকা কেজিতে কিনতে। সকালে আমরা ১৩০ টাকায় কিনছিলাম।’
কৃষক ও আড়তদারদের দাবি, বর্তমানে সবজির দাম বেড়েছে সরবরাহের ঘাটতি এবং অসময়ে বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে। আড়তদারেরা জানান, এখন সবজির পুরো মৌসুম না হলেও প্রতিদিন মুলাডুলি মোকাম থেকে ২০০ থেকে ৩০০ টন সবজি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হচ্ছে।
বন্যায় ৬০ লাখ একরের শস্য নষ্ট হয়েছে: উপদেষ্টা
এদিকে নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, দুর্যোগ ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেছেন, ‘বন্যার কারণে খাবারে ঘাটতি হয়েছে এটা সত্য ৷ আমি বেশ কিছু বন্যাদুর্গত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। এসব অঞ্চলে প্রায় ৬০ লক্ষ হেক্টর জমির শস্য নষ্ট হয়েছে। এই ঘাটতি রাতারাতি পূরণ করা সম্ভব না হলেও আমরা দ্রুত জোগান দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ গতকাল পূর্বাচল ফায়ার সার্ভিস ও মাল্টিপারপাস ট্রেনিং গ্রাউন্ডে ১১টি অত্যাধুনিক গাড়ি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা এই মন্তব্য করেন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন জাহিদ হাসান, যশোর; গনেশ দাস, বগুড়া; দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ, কুমিল্লা ও খোন্দকার মাহাবুবুল হক, ঈশ্বরদী (পাবনা)]