কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশের মতোই অবস্থা বিএনপি নেতাকর্মীর। কেউ আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন, আর কেউ নিজের আখের গুছিয়েছেন। আন্দোলনের লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অন্যদিকে, তৃণমূল নেতাকর্মীরা মামলা-হামলায় জর্জরিত হয়ে এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
দলের বিভিন্ন প্রতিবেদন আর জ্যেষ্ঠ নেতাদের স্বীকারোক্তিতে এসব চিত্র ফুটে উঠেছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আড়াই মাসের আন্দোলন চলাকালে এসব ঘটেছে।
বিএনপির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, গত বছরের অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা, নেতাকর্মীর দেখভাল করা, হামলা-মামলায় নির্যাতিত নেতাকর্মীর পাশে থাকার জন্য দলের তহবিল থেকে দায়িত্বশীল নেতাদের অর্থ দেওয়া হয়। এর বাইরে আন্দোলনের নাম করে ধনাঢ্য নেতা কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করেন অনেকে। সব মিলিয়ে বড় ধরনের আর্থিক তহবিল গঠন হলেও নেতাকর্মীরা ছিটেফোঁটাও পাননি। এ কারণে অনেক এলাকায় আন্দোলন গড়ে ওঠেনি।
এসব বিষয়ে জানার জন্য দলের একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্যের সঙ্গে কথা বললেও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে রাজি হননি। তবে আন্দোলন চলাকালে দলের দায়িত্বশীল একজন নেতা সমকালকে জানান, ভয়াবহ আর্থিক অনিয়ম হয়েছে রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ বিভাগ ও সিলেট জেলায়। সবচেয়ে বেশি অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী বিভাগে। সেখানে সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু কারাগারে থাকায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সহসাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকতকে।
বিএনপি নেতারা জানান, দলের পক্ষ থেকে যে অর্থ দেওয়া হয়েছিল, তার বাইরেও নেতারা চাঁদা সংগ্রহ করেছেন বলে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। তবে দল থেকে যে সহায়তা করা হয়েছে, তাও নেতাকর্মীর মধ্যে বণ্টন না করে নিজেদের পকেট ভারী করেছেন। দলের কাছে তারা নামকাওয়াস্তে হিসাব জমা দিলেও তাতে অনেক গরমিল রয়েছে।
আন্দোলনকালীন আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দিয়েছে সিলেট জেলা বিএনপি। ওই প্রতিবেদনে ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা আয় এবং ২৫ লাখ ৫ হাজার টাকার খরচ দেখানো হয়েছে। হিসাব জমা দিয়ে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত টাকা নিজেরা বহন করেছেন। তবে এই প্রতিবেদকের কাছে লন্ডন ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির একাধিক নেতা অভিযোগ করে বলেন, আন্দোলনকালীন তারা বিভিন্ন সময়ে টাকা দিয়েছেন। তার পরিমাণও ২০ লাখের ওপর। অথচ, সেই টাকার হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, তিনি নিজে ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন জেলা বিএনপিকে। সেখান থেকে ৩০ লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয় আন্দোলনের পর।
অভিযোগ উঠেছে, আন্দোলনকালীন স্থানীয় নেতাদের ভূমিকা নিয়ে সিলেট জেলা বিএনপির প্রতিবেদনে নিজেদের বলয়ের নেতাকর্মীকে উপস্থাপন করা হয়েছে ইতিবাচকভাবে, আর অন্যদের তথ্য দেওয়া হয়েছে নেতিবাচকভাবে।
সিলেট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। আন্দোলনের সময়ে তাঁর ওপর এ রকম কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তারা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।
বরিশাল মহানগর বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, পুরো আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন এই বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন। তবে আড়াই মাসের আন্দোলনে তিনি মাঠে ছিলেন না। নেতাকর্মীর খোঁজ রাখেননি। আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে কোনো ভূমিকা ছিল না তাঁর। এমনকি গত বছরের ১৮ ও ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশ ও মহাসমাবেশের জন্য দেওয়া দলীয় তহবিলের টাকাও তছরুপ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আসা-যাওয়া, খাওয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রমে নেতাকর্মীরা কোনো সহায়তা পাননি।
দলের একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য জানান, আন্দোলনকালীন প্রতিটি বিভাগে পৃথক সমন্বয়ক ছিলেন। ওই সময়ে নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য দল থেকে বিভাগকে প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্যও করা হয়। প্রতিটি বিভাগে দল থেকে অর্ধকোটি টাকার বেশি সহায়তা দেওয়া হয় তখন।
এ ছাড়া ধনাঢ্য নেতা কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকেও অনুদান নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে কোথা থেকে কত টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে, তার প্রকৃত চিত্র দলের কাছে নেই।
বরিশাল বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নু জানান, আন্দোলন পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে। তখন কোথায় কত টাকা দেওয়া হয়েছে, কাকে দিয়েছেন তা তিনি ভালো বলতে পারবেন। তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি আবুল হোসেন খান জানান, আন্দোলনকালীন তিনি কোনো টাকা পাননি। তিনি নিজে বিভিন্ন সুহৃদের কাছ থেকে ধারদেনা ও অনুদান নিয়ে আন্দোলনে ব্যয় করেছেন, নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়িয়েছেন।
একইভাবে বরিশাল উত্তর জেলা, মহানগর ছাড়াও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও জানান, আন্দোলন চলাকালে তাদের কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। তবে শুনেছেন, বিলকিস জাহানের ঘনিষ্ঠজনরা ছিলেন ব্যতিক্রম। তারাও আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে বরিশাল দক্ষিণ জেলার সদস্য সচিব আবুল কালাম শাহীন, ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম ইমরান ছাড়া অন্য কোনো নেতা টাকা পাননি বলে দলের কাছে দাবি করেন স্থানীয় নেতারা।
শুধু আন্দোলনকালীন আর্থিক কেলেঙ্কারিই নয়, এই বিভাগে সাংগঠনিক সক্ষমতাকেও দুর্বল করে তোলা হয়েছে বিগত দিনে। সেখানেও আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা রয়েছে। স্থানীয়ভাবে যেসব নেতা সাধারণ মানুষের কাছে সম্মানিত, তাদেরই বেছে বেছে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বরিশাল বিভাগের আন্দোলনে। কেউ রাজপথে নামেননি।
বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন স্বীকার করেন সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে তিনি বিভাগে আন্দোলনের সমন্বয়কারী ছিলেন। আন্দোলনের তহবিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আন্দোলনে আবার তহবিল কীসের? তাঁর কাছে দলের তহবিল থাকার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্র সবকিছু জানে, তারা সেভাবেই মূল্যায়ন করবে।
বরিশাল বিভাগের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা চট্টগ্রাম বিভাগে। আন্দোলন চলাকালে দলের আর্থিক সহায়তার বাইরেও বিভাগের অনেক ধনাঢ্য নেতা ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া হয়েছে। তবে এর ছিটেফোঁটাও ভাগ্যে জোটেনি তৃণমূল নেতাকর্মীর। কারাগারে কিংবা আহত কর্মীদের পাশে দাঁড়াননি দায়িত্বশীল নেতারা। এমনকি জেলা পর্যায়েও কোনো সহায়তা করা হয়নি বলে জানান বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা।
শুধু চট্টগ্রাম উত্তর জেলায় নামকাওয়াস্তে কিছু সহায়তা করা হলেও মহানগর, দক্ষিণ জেলাসহ অঙ্গ সংগঠনের কোনো নেতাকর্মীকে সহায়তা করা হয়নি বলে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক কেন্দ্রীয় নেতারা জানান। এই বিভাগের সমন্বয়ক ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম।
চট্টগ্রাম জেলার একজন নেতা জানান, শামীমের স্ত্রী শিরিন আক্তার আইভি ও আরও কয়েকজন মিলে খুলশী জালালাবাদে ১৪ কাঠা জমির ওপর ১২ তলা টাওয়ার নির্মাণ করছেন। ইতোমধ্যে ৯ তলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এটা নিয়ে বিভাগের প্রত্যেক নেতাকর্মীর মধ্যে কানাঘুষা চলছে।
পাশাপাশি কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করেও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন এ বিভাগের সাংগঠনিক নেতারা। বিভিন্ন কমিটি গঠনে অনিয়মের জন্য একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেসব তদন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কমিটি গঠন নিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। শামীমের বিরুদ্ধে তদন্ত টিমও গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় বিএনপির তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলালকে এই টিমের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে সেই তদন্ত প্রতিবেদন আর জমা পড়েনি বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক জালাল উদ্দিন মজুমদার বলেন, আর্থিক বিষয়ে তিনি কখনও নিজেকে জড়ান না। নিজের পকেট থেকে সাধ্যমতো দলের নেতাকর্মীর পেছনে ব্যয় করেন। সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম বলেন, দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না।