
মোঃ শাহজাহান বাশার ,সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং–ব্রাহ্মণপাড়া) আসনে এখন বইছে নির্বাচনী উত্তাপ। এই আসনে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রভাব থাকলেও এবার ভিন্ন চিত্র তৈরি হয়েছে। বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে হাজী জসিম উদ্দিন নাম ঘোষণা করার পর মাঠে নামছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি অ্যাডভোকেট ড. মোবারক হোসাইন। ফলে বিএনপির বিরুদ্ধে এবার সরাসরি লড়াইয়ে নামছে জামায়াত। পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন ব্যারিস্টার সোহরাব খান চৌধুরী।
বাংলাদেশের প্রাচীন ও জনবহুল জেলাগুলোর একটি কুমিল্লা। ভারত সীমান্তবর্তী এই জেলার ১১টি সংসদীয় আসনের মধ্যে কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক ক্ষেত্র। এ আসনটি মোট ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত— এর মধ্যে বুড়িচং উপজেলায় ৯টি এবং ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় রয়েছে ৮টি ইউনিয়ন।
স্বাধীনতার পর থেকে এ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পালাবদল হয়েছে একাধিকবার। মোট ১২টি জাতীয় ও উপ-নির্বাচনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে ছয়বার, বিএনপি দুইবার। বাকি সময়গুলোতে স্বতন্ত্র বা বিকল্প দলের প্রার্থীরাই মাঠে থেকেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে।
এই আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে সর্বাধিকবার নির্বাচিত হয়েছেন প্রয়াত সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু। তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে মোট পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অন্যদিকে বিএনপির অধ্যাপক মো. ইউনুস ২০০১ সালে জয়ী হয়ে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছিলেন।
তবে মতিন খসরু ও অধ্যক্ষ ইউনুসের মৃত্যুর পর এ আসনে নেতৃত্বে দুর্বলতা দেখা দেয়— বিশেষ করে বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও নেতৃত্ব সংকট বড় আকার নেয়। মনোনয়ন ও সাংগঠনিক সমন্বয়ের অভাবে গত কয়েকটি নির্বাচনে দলটি ভোটের মাঠে সুবিধা করতে পারেনি।
বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া জুড়ে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে হাজী জসিম উদ্দিনের নাম ঘোষণার পর সমর্থকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই দাবি করছেন, জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে দল পুনরুজ্জীবিত হতে পারে, তবে একাংশ মনে করছে— দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও দীর্ঘদিনের বিভাজন মাঠের ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে।
মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েছেন দলের একাধিক আলোচিত নেতা— যেমন, বিএনপির প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস, শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এডুকেশন কমিটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম মিজানুর রহমান, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি এসএম আলাউদ্দিন ভূঁইয়া এবং ডা. মো. নজরুল ইসলাম শাহীন।
বিএনপি মনোনয়ন প্রকাশের পর থেকেই আলোচনায় উঠে এসেছে জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট ড. মোবারক হোসাইন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে তাঁর সাংগঠনিক প্রভাব রয়েছে দুই উপজেলা জুড়েই। গণসংযোগ, বাড়ি বাড়ি প্রচারণা, উঠান বৈঠক— সর্বত্রই তাঁর সক্রিয়তা চোখে পড়ছে।
ড. মোবারক হোসাইন বলেন, “দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি। তরুণ সমাজ এখন পরিবর্তন চায়— তারা দুর্নীতিবাজ, মাদকসংশ্লিষ্ট নেতাদের আর দেখতে চায় না। ইনশাআল্লাহ, কুমিল্লা-৫ আসনে এবার দাঁড়িপাল্লা জিতব।”
রাজনৈতিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সোহরাব খান চৌধুরী। তিনি বলেন, “দলীয় রাজনীতির দীর্ঘদিনের সংঘাত ও বিভাজনে সাধারণ মানুষ আশাহত। এই বাস্তবতায় জনগণের বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি।”
তাঁর এই উদ্যোগ তরুণ ও শিক্ষিত ভোটারদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে বলে জানা গেছে।
এ আসনে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির কেন্দ্রীয় প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার যোবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া, বাংলাদেশ লেবার পার্টির প্রার্থী সাংবাদিক কাজী খোরশেদ আলম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও ইসলামী ফ্রন্টের নেতারাও প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এখনো ঘোষণা আসেনি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণ অধিকার পরিষদের প্রার্থীদের নাম।
দুই উপজেলার গ্রামাঞ্চলে বিএনপির নেতাকর্মীরা পোস্টার, লিফলেট, গণসংযোগ, সমাবেশ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে জামায়াতের প্রার্থী ও সমর্থকরাও গণসংযোগে ব্যস্ত। তারা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীকে ভোট চাচ্ছেন।
হাজী জসিম উদ্দিন তার নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে এক নির্দেশনায় জানিয়েছেন, “মনোনয়নকে কেন্দ্র করে মিছিল, আতশবাজি, শোডাউন বা মিষ্টি বিতরণের মতো কর্মসূচি থেকে বিরত থাকতে হবে।”
এ আসনের ভোটাররা বলছেন, আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত থাকলে বিএনপি-জামায়াতের লড়াই জমে উঠবে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর উপস্থিতি ভোটের হিসাব বদলে দিতে পারে। তরুণ ভোটারদের আগ্রহ, নারী ভোটারদের অংশগ্রহণ ও গ্রামীণ জনসম্পৃক্ততাই নির্ধারণ করবে শেষ পর্যন্ত কে এগিয়ে থাকবে কুমিল্লা-৫ আসনের মাঠে।





