
মো. শাহজাহান বাশার, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার
বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাসে এমন কিছু মহাপুরুষ রয়েছেন, যাদের নূরানী উপস্থিতি ও শিক্ষা শুধু একটি সমাজ বা যুগ নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আলোকিত করে রেখেছে। তাঁদেরই অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন গাউসুল আযম হযরত সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবাভাণ্ডারী (রহঃ) — তরিকায়ে মাইজভাণ্ডারীয়ার দ্যুতিময় মহাসাধক, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ২৮তম বংশধর এবং বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব।
১৮৬৫ সালে (১২৭০ বঙ্গাব্দ ২৯ আশ্বিন) চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার পবিত্র মাইজভাণ্ডার গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন গাউসুল আযম হযরত সৈয়দ আহমদউল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (কঃ)-এর ভাইয়ের পুত্র। তাঁদের পূর্বপুরুষ হযরত সৈয়দ হামিদউদ্দিন গৌরী (রহঃ) ১৫৭৫ সালে আরব থেকে বাংলায় আগমন করেন এবং গৌড়ের প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তাঁর বংশধরগণ চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে সেই অঞ্চল পরিচিত হয় “মাইজভাণ্ডার” নামে — যেখান থেকে বিশ্ববিখ্যাত তরিকা-এ-মাইজভাণ্ডারীয়া-এর সূচনা।
শৈশব থেকেই হযরতের মাঝে অলৌকিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যেত। দোলনায় কারো সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে দুলতেন, মুখমণ্ডল থেকে বিচ্ছুরিত হতো নূরের আলো। অমুসলিমরাও তাঁর মুখমণ্ডল দেখে বিমুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতেন। গাউসুল আযম আহমদউল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (কঃ) একবার বলেছিলেন—
“এই শিশু আমার বাগানের শ্রেষ্ঠ গোলাপ; ইউসুফ (আঃ)-এর সৌন্দর্য তার চেহারায় বিদ্যমান।”
তাঁর জন্মের পর থেকেই এলাকায় নেমে আসে অফুরন্ত বরকত — ফসলের ফলন বৃদ্ধি, পশুর দুধের প্রাচুর্য, মানুষের অন্তরে শান্তির জোয়ার। সবাই তাঁকে “খোদার রহমত” বলে ডাকতে শুরু করে।
শিক্ষাজীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ফটিকছড়ির ফোরকানিয়া মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষে চট্টগ্রামের মুহসেনিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। শিক্ষকরা তাঁর মেধায় মুগ্ধ হয়ে বলতেন—
“এই ছাত্র হবে একদিন যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম ও ওলি।”
ছাত্রাবস্থায় গভীর রাতে মসজিদে গিয়ে একা নামাজ পড়তেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখেছেন— তাঁর পেছনে সাদা পোশাকধারী অদৃশ্য ব্যক্তিরা নামাজ পড়তেন, যাদেরকে পরে ফেরেশতা বলে বিশ্বাস করা হয়।
২৫ বছর বয়সে পরীক্ষার সময় তিনি আধ্যাত্মিক উন্মেষে এমন এক অবস্থায় পৌঁছান, যেখানে তাঁর চেতনা হারিয়ে যায়। তাঁকে তখন মাইজভাণ্ডার দরবারে নিয়ে আসা হয়— সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর দীক্ষা, আধ্যাত্মিক জাগরণ ও ঈশ্বরপ্রেমের মহান যাত্রা।
গাউসুল আযম আহমদউল্লাহ (কঃ)-এর নির্দেশে তিনি একাকী অবস্থানে ১২ বছর পাহাড়ে নির্জন সাধনায় লিপ্ত থাকেন। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাঁর চারপাশে বাঘ, হায়না ও সাপ শান্তভাবে অবস্থান করত। তাঁর অবস্থানস্থলে নূরের আলো বিচ্ছুরিত হতো। পাহাড়ি উপজাতি ও অমুসলিমদের অনেকেই তাঁর অলৌকিক প্রভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন।
আজও খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি ও ফটিকছড়ির পাহাড়ে তাঁর ধ্যানস্থ স্থানগুলো আশেকানদের কাছে পবিত্র তীর্থভূমি হিসেবে বিবেচিত হয়।
দীর্ঘ সাধনার পর দরবারে ফিরে তিনি বহু বছর নিরব থেকেছেন— কিন্তু যখনই দোয়া করতেন, আল্লাহ তা কবুল করতেন। তাঁর দোয়ার বরকতে অসংখ্য অসুস্থ সুস্থতা লাভ করেন, নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তান লাভ করেন, অমুসলিমরা ইসলাম গ্রহণ করেন।
গাউসুল আযম বাবাভাণ্ডারী (রহঃ)-এর তরিকায় প্রতিফলিত হয় খোদার প্রতি ভালোবাসা, মানবতার প্রতি সহানুভূতি ও সৃষ্টির সেবায় আত্মত্যাগের শিক্ষা। তাঁর জীবন ছিল স্রষ্টার প্রেমে মগ্ন, সৃষ্টির কল্যাণে নিবেদিত।
বাংলাদেশে সুফিবাদ ও মানবতার আধুনিক ধারায় মাইজভাণ্ডারীয়া তরিকা হয়ে উঠেছে এক অনন্য উদাহরণ। জার্মান অধ্যাপক ড. হ্যান্স হার্ডার তাঁর গবেষণায় লিখেছেন—
“The Maijbhandaris of Chittagong have created a unique model of humanitarian Sufism in modern South Asia.”
১৯৩৭ সালের ৫ এপ্রিল (১৩৪৩ বঙ্গাব্দ ২২ চৈত্র, ২২ মহররম) তিনি মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন তাঁর মেঝো শাহজাদা হযরত সৈয়দ আবুল বশর আল হাসানী মাইজভাণ্ডারী (কঃ)।
প্রতি বছর তাঁর জন্মবার্ষিকী (২৯ আশ্বিন) ও ওফাত দিবস (২২ চৈত্র) লক্ষ লক্ষ আশেকান ও ভক্তদের উপস্থিতিতে দরবার শরীফে মহাসমারোহে পালিত হয়।
আজও তাঁর সমাধিস্থল নূরের আলোয় উদ্ভাসিত। যেন হযরত রুমী (রহঃ)-এর সেই বাণী জীবন্ত হয়ে ওঠে—
“দেখো! আল্লাহ কিভাবে তাঁর বন্ধুদের স্থানকে নূরের আলোয় ভরিয়ে রেখেছেন। এ আলো সাধারণ আলো নয়, এটি খোদার নূর।”
গাউসুল আযম সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবাভাণ্ডারী (রহঃ) শুধু একজন সুফি সাধক নন—
তিনি মানবতার দিশারি, ভালোবাসার দূত, এবং আল্লাহপ্রেমের চিরন্তন প্রতীক।
তাঁর তরিকায়ে আজও উচ্চারিত হয় সেই অমর বাণী—“স্রষ্টাকে ভালোবাসো, সৃষ্টির সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দাও।”






