
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে প্রায়ই পাহাড় ধসের খবর পাওয়া যায় দেশের চট্টগ্রামসহ পার্বত্য জেলাগুলোতে। এতে মানুষের হতাহতের ঘটনাও ঘটে প্রায়শই। পাহাড়ের নিজস্ব প্রজাতির (ইনডিজিনাস) গাছ কেটে ফেলা, পাহাড় কেটে সমতল করাসহ নানা কারণে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের দার্জিলিংয়ে সম্প্রতি ভূমিধসে ২০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ভারি বৃষ্টির পর মিরিক ও সুখিয়াপোখরির মতো এলাকায় ভূমিধস দেখা দেয়। ভূমিধসের জন্য সৌন্দর্যবর্ধনে কৃত্রিম বনায়নকে দায়ী করেছেন ভারতীয় লেখক ও দার্জিলিং গবেষক পরিমল ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, ‘দার্জিলিংয়ের সূচনা থেকে সেখানকার প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের একটি বৈরিতার সম্পর্ক রয়েছে। ২০ শতকের শুরুর দিকে পাহাড়ের প্রাকৃতিক গাছগুলো কেটে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য জাপানিজ পাইন লাগানো হয়।
সেই গাছ ছেয়ে গেল। এই গাছের নিচে অন্য কোনো গাছ বাড়ে না। এই গাছের পাতা এসিডিক এবং পচনশীল নয় ফলে এটা সেখানের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করেছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে যেখানে এই জাপানিজ পাইনের আধিক্য বেশি সেখানে পাহাড় ধস বেশি হয়েছে।
পার্শ্ববর্তী দেশের এই পাহাড় ধসকে বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে জাপানিজ পাইন না থাকলেও সেখানকার প্রাকৃতিক গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। সেখানে কৃত্রিমভাবে রোপণ করা সেগুন ও ইউক্যালিপটাসের মতো গাছগুলো পাহাড়ের বাস্তুসংস্থান ধ্বংসের অন্যতম কারণ বলে মত তাদের।
পার্বত্য তিন জেলার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্ষাকালে প্রায়ই পাহাড়ে ধস নামে। জনবসতিহীন পাহাড়গুলোতে নিয়মিত ধসের ঘটনা ঘটলেও তা বেশিরভাগ সময় চোখ এড়িয়ে যায়।
যেসব পাহাড়ে ধস হচ্ছে তার সিংহভাগেই কৃত্রিম বনায়ন করা হয়েছে। স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই সেগুন গাছ লাগানো হয়েছে। এই গাছটি পাহাড়ি অঞ্চলের নিজস্ব (ইনডিজিনাস) প্রজাতি নয়। এই গাছের নিচে অন্য কোনো গাছ, এমনকি দূর্বাঘাসও জন্মায় না।
কক্সবাজারের উখিয়া এলাকার বাসিন্দা হারুনুর রশিদ বলেন, ‘বেশিরভাগ পাহাড়ে সেগুন গাছ, আকাশমণি গাছ রোপণ করা হচ্ছে। এসব গাছের নিচে অন্য কোনো গাছ জন্মায় না। এই গাছগুলো পানি শোষণ করে অনেক বেশি। এ কারণে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।’
চট্টগ্রামের পাহাড় ধস নিয়ে গবেষণা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. নাইমুর রহমান। তিনি জানান, জনবসতি থেকে একটু দূরে গেলেই দেখা যায় পাহাড় থেকে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। বড় গাছ কেটে ফেলায় এর শিকড় আর মাটি ধরে রাখতে পারছে না। বৃষ্টির পানি সব পাহাড়ের মাটি শুষে নিচ্ছে। এতে পাহাড় নরম হয়ে গিয়ে পাহাড় ধস হচ্ছে। আবার পাহাড়ের যে পাশে রোদ আসে, সেই পাশের সব গাছ কেটে জুম চাষ করা হচ্ছে এতেও মাটিক্ষয় ও ভূমিধস হচ্ছে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি দীপক শর্মা দীপু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাহাড়ের ভেতরে যাতে বৃষ্টির সব পানি না ঢুকে যায়, সে কারণে পাহাড়ে গুল্ম জাতীয় গাছ ও ঘাস জন্মায়। এর ফলে মাটি সব পানি শুষে নিতে পারে না, পানি পাহাড় গড়িয়ে নিচে চলে যায়। পাহাড়ে এই গাছগুলো না থাকলে পানি পাহাড়ের ভেতরে ঢুকে গিয়ে মাটি নরম হয়ে যায়। এক পর্যায়ে পাহাড় ধস হয়।’
কৃত্রিম বনায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গুল্মজাতীয় গাছ এবং কিছু বড় গাছ যেগুলোর শিকড় ছড়ানো থাকে এগুলো মাঝারি উচ্চতার পাহাড় ও টিলার ক্ষতি করে না। তবে ঢালু পাহাড়গুলোর ক্ষেত্রে সেগুন, ইউক্যালিপটাসের মতো গাছগুলোও ঝুঁকি তৈরি করে। আর যেসব গাছের শেকড় মাটির গভীরে যায়, তবে ছড়ায় না; সেই গাছগুলো মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে।’






