আইনি পথেই নিষিদ্ধ হতে পারে আওয়ামী লীগ

সরকারি নীতিনির্ধারকদের নির্দেশে শুরু তদন্ত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যেতে পারে মামলা

মোঃ শাহজাহান বাশার,সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার

বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব এক পদক্ষেপের ইঙ্গিত মিলছে— আইনি প্রক্রিয়াতেই নিষিদ্ধ হতে পারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারক সূত্রগুলো জানিয়েছে, দলটির বিরুদ্ধে “মানবতাবিরোধী অপরাধ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, রাজনৈতিক সহিংসতা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার” অভিযোগে প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হবে বলে নিশ্চিত করেছে প্রসিকিউশন সূত্র।

সরকার পরিবর্তনের প্রায় ছয় মাস পর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ভারত থেকে একাধিক গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, বাংলাদেশের জনগণ আমাকে আবার ডাকবে।”

তার ওই বক্তব্যের পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দলটি নিষিদ্ধের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, আওয়ামী লীগ অতীতের মতোই রাজনৈতিক দল নয়, বরং একটি “অপরাধ সংগঠনে” পরিণত হয়েছে, যার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের মুখোমুখি করা প্রয়োজন।

প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দেয় যে,“যতক্ষণ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর বিচার সম্পন্ন না হয়, ততক্ষণ দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম, সভা-সমাবেশ ও প্রচার কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।”

এরপর থেকেই সরকারিভাবে আওয়ামী লীগের অফিস, কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও বিভিন্ন ইউনিট কমিটি কার্যত নিষ্ক্রিয় ও নজরদারির আওতায় রয়েছে।সরকারের নীতিনির্ধারকরা এখন দলটিকে একটি ‘আইনি সত্তা’ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের আওতায় আনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে কয়েকজন অভিজ্ঞ আইন কর্মকর্তা, তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউশন প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

একজন জ্যেষ্ঠ তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন,“আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংঘটিত বিভিন্ন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রশাসনিক অপরাধ— এসবের দলিল-প্রমাণ সংগ্রহ চলছে। এটি শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, বরং দলীয়ভাবে সংঘবদ্ধ অপরাধের প্রমাণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।”

তিনি আরও জানান, তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত হওয়ার পর তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় জমা দেওয়া হবে। আদালত তা গ্রহণ করলে আনুষ্ঠানিকভাবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে।

বিচার বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘দল হিসেবে বিচার’ আন্তর্জাতিক আইনের নতুন নজির স্থাপন করবে। ১৯৯০-এর দশকে যুগোস্লাভ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে কিছু সংগঠনকে অভিযুক্ত করা হলেও, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি হবে প্রথম দৃষ্টান্ত যেখানে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দলকে অপরাধ সংগঠন হিসেবে বিচার করা হতে পারে।

একজন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ বলেন,“যদি প্রমাণ হয় যে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল, তবে ট্রাইব্যুনাল তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। এটি কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হবে।”

তদন্ত শুরুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট নেতৃত্বের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ ও বিভাজন দেখা দিয়েছে।
দলের এক সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন,“আমরা মনে করেছিলাম সরকার হয়তো আমাদের নিষিদ্ধ করবে রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু এখন শুনছি, এটি আইনি প্রক্রিয়ায় হচ্ছে— যা অনেক বেশি জটিল ও বিপজ্জনক।”

অপরদিকে, কিছু নেতা মনে করছেন— আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করার উদ্যোগটি রাজনৈতিক প্রতিশোধেরই বহিঃপ্রকাশ।

তবে সরকারপক্ষের বক্তব্য স্পষ্ট—“কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যে কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় অপরাধে জড়িত থাকলে তার বিচার হবেই।”

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ঘটনাটি নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক মোড় আনতে পারে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার অভিযোগে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যদি দল হিসেবে বিচার শুরু হয়, তবে তা দক্ষিণ এশীয় গণতন্ত্রে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, রাজনীতির মেরুকরণ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বের হয়ে এই পদক্ষেপকে শুধুমাত্র আইনি ও ন্যায়বিচারিক কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
নচেৎ, এটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য আরও বিভাজন ও অস্থিতিশীলতা ডেকে আনতে পারে।