মাহে রবিউল আউয়ালের আগমনে সারা দুনিয়া আনন্দিত

মোঃ শাহজাহান বাশার,সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার

আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন মানবজাতির হেদায়েতের জন্য। কিন্তু শেষ নবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হিসেবে তিনি যাকে প্রেরণ করেছেন, তিনি হলেন আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)। তাঁর আগমনে পৃথিবীর অন্ধকার দূর হয়েছে, কুফর-শিরকের বেড়াজাল ভেঙে ইসলামের আলো বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেই আগমনের মাহেন্দ্রক্ষণ ছিল রবিউল আউয়াল মাস। এজন্য এ মাস মুসলিম উম্মাহর কাছে আনন্দ, কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা ও আশীর্বাদের মাস।

ইসলামের মূল দলিল—কোরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস—সবগুলোর আলোকে রবিউল আউয়াল মাসে নবীজীর জন্মকে স্মরণ করা ও আনন্দ প্রকাশ করা একটি গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসনীয় আমল।

আল্লাহ তায়ালা কোরআনে ইরশাদ করেন:“আর আমি আপনাকে (হে নবী মুহাম্মদ সা.) বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।”
(সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)

এ আয়াতের স্পষ্ট অর্থ হলো—রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আগমন সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমত। তাঁর জন্মই পৃথিবীতে আল্লাহর সবচেয়ে বড় নেয়ামত।

আরেক স্থানে আল্লাহ বলেন:“বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের কারণে—সেই জন্যই তারা আনন্দিত হোক। এটি তাদের সঞ্চয়ের চেয়ে শ্রেয়তর।”
(সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫৮)

বিখ্যাত মুফাসসিরগণ যেমন ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (রহ.) ব্যাখ্যা করেছেন—এখানে আল্লাহর রহমত বলতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং তাঁর জন্মের মাসে আনন্দিত হওয়া সরাসরি কোরআনের শিক্ষা।

হাদীসের আলোকে নবীজীর জন্ম দিবসের মর্যাদা:-
রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে তাঁর জন্মদিনকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছেন। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত:- রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতি সোমবার রোজা রাখতেন। যখন সাহাবারা এর কারণ জানতে চান, তিনি বলেন— “এ দিনেই আমার জন্ম হয়েছে এবং এ দিনেই আমার উপর নবুওয়াত নাযিল করা হয়েছে।”
(সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১১৬২)

এ থেকে স্পষ্ট হয়, নবীজী নিজেই তাঁর জন্ম দিবসকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইবাদত করেছেন। তাই তাঁর জন্মের মাসে উম্মাহর আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সুন্নাহর অনুসরণ।

এ ছাড়া, হাদীসে আছে—নবীজী যখন মদিনায় হিজরত করে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছে মুসা (আ.)-এর বাঁচার কারণে, তখন তিনি বললেন: “আমরা মুসার চেয়ে বেশি হকদার।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস: ২০০৪),এখানে নবীজী অতীতের মহান ঘটনার স্মরণে ইবাদতকে অনুমোদন দিয়েছেন। তাহলে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা—রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম—স্মরণ করে আনন্দ প্রকাশ করা তো আরও বেশি গ্রহণযোগ্য।

ইসলামের ইতিহাসে অসংখ্য ইমাম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও আউলিয়ায়ে কেরাম রবিউল আউয়াল মাসে নবীজীর জন্ম উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশ করেছেন।

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন:
“রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মের মাসে আনন্দ প্রকাশ করা, দরুদ ও সালাম পড়া এবং সৎকাজ করা নিঃসন্দেহে আল্লাহর রহমত ও কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।”

ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (রহ.) তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন:
“রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম দিবসে আনন্দ প্রকাশ করা মুস্তাহাব এবং এ বিষয়ে আলেমদের সর্বসম্মত মতামত রয়েছে।”

বিখ্যাত সুফি আউলিয়া হযরত শায়খ আবদুল কাদির জিলানি (রহ.) তাঁর মাজলিসে রবিউল আউয়াল মাসে বিশেষ ইবাদত ও দোয়া-মাহফিলের আয়োজন করতেন।

এভাবে আলেম সমাজের ইজমা প্রমাণ করে যে, নবীজীর জন্ম উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশ করা ইসলামের ইতিহাসে গৃহীত ও প্রশংসিত একটি আমল।

কিয়াস বা তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতেও রবিউল আউয়ালের তাৎপর্য স্পষ্ট।
রমজান মাসে কোরআন নাযিল হওয়ার ঘটনায় আমরা আনন্দ প্রকাশ করি, ইবাদত বাড়াই।

বদর যুদ্ধের বিজয় দিবসে সাহাবায়ে কেরাম শুকরিয়া আদায় করেছেন।

সন্তান জন্মালে মুসলিমরা আকীকা করে আনন্দ প্রকাশ করেন।

যখন আল্লাহর নেয়ামতের কারণে আনন্দ করা জায়েজ ও মুস্তাহাব, তখন সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত—রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম উপলক্ষে আনন্দ করা অবশ্যই বৈধ, বরং উত্তম।

রবিউল আউয়াল মাসে মুসলিম উম্মাহর করণীয়
১. বেশি বেশি দরুদ শরীফ পাঠ করা।
২. নবীজীর জীবনী অধ্যয়ন ও তার আলোকে জীবন গঠন করা।
৩. মাহফিল, মিলাদ, দোয়া-মুনাজাতের আয়োজন করা।
৪. গরিব-দুঃখী মানুষের মাঝে দান-খয়রাত করা।
৫. সমাজে শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।

মাহে রবিউল আউয়াল শুধু একটি মাস নয়—এ মাস মানবতার ইতিহাসে আলোকবর্তিকার আগমনের মাস। এ মাসে পৃথিবী পেয়েছিল সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, রহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-কে। তাই মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য হলো এই মাসে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার সাথে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা, নবীজীর সুন্নাহর অনুসরণে জীবন গঠন করা এবং উম্মাহর ঐক্য ও শান্তির জন্য কাজ করা।

আমাদের আনন্দ হোক ইবাদতে, আমাদের উদযাপন হোক কৃতজ্ঞতায়, আর আমাদের জীবন হোক প্রিয়নবীর আদর্শে আলোকিত।