
এলজিইডি প্রকৌশলী সাবরীন মাহফুজের ‘আমি ভবনের মালিক’ মন্তব্যে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা প্রশ্নের মুখে
ইউএনওর নিরবতায় ক্ষোভ, সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় বিভাগীয় তদন্ত ও শাস্তির দাবি**
মোঃ শাহজাহান বাশার,স্টাফ রিপোর্টার
কুমিল্লার লালমাই উপজেলা পরিষদের নতুন প্রশাসনিক ভবনে সরকারি কক্ষ বরাদ্দ ও ব্যবহারের নামে ভয়াবহ অনিয়ম, দখলদারিত্ব এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী সাবরীন মাহফুজের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় সাংবাদিকদের সরকারি তথ্য জানতে চাওয়ার পর তিনি প্রকাশ্যে এক সাংবাদিককে মামলার হুমকি দেন এবং “আমি এই ভবনের মালিক, ইউএনও শুধু সই করবেন, ভাগ-বাটোয়ারা করবো আমি”— এমন চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করেন। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনিক মহলে নিন্দার ঝড় উঠেছে এবং জেলাজুড়ে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঢেউ।
গত শনিবার (২১ জুন) বিকেলে লালমাই উপজেলা পরিষদের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা দেখতে পান—সেখানে ৮টি সরকারি কক্ষ তালাবদ্ধ এবং প্রতিটি কক্ষের বাইরে “এলজিইডি” লেখা স্টিকার সাঁটানো। বিষয়টি সন্দেহজনক মনে করে সাংবাদিকরা জানতে চান—উপজেলা কক্ষ বরাদ্দ কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া এতগুলো কক্ষ কিভাবে একক দপ্তরের নামে দখলে রাখা হলো?
প্রকৌশলী সাবরীন মাহফুজের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি চরম ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন—“আমি প্রোকিউরমেন্ট এন্টিটি সেক্রেটারি। এই ভবনের মালিক আমরাই। কে কোথায় বসবে তা আমি ঠিক করবো। ইউএনও শুধু সই করবেন। আপনাকে আমি মামলায় দেবো।”
এই বক্তব্যের ভিডিও প্রমাণ সাংবাদিকদের মোবাইলে ধারণ করা হয়, যা এখন ‘আমার দেশ’সহ জাতীয় গণমাধ্যমে পৌঁছে গেছে।
ঘটনার বিষয়ে লালমাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও কক্ষ বরাদ্দ কমিটির সভাপতি হিমাদ্রি খীসা জানান—“একজন ইঞ্জিনিয়ার ফোন করে বিষয়টি আমাকে জানান। প্রকৌশলী সাবরীন মাহফুজ এ বিষয়ে আমাকে কিছুই জানাননি। আমি এখনো কিছু বলিনি, ধৈর্য ধরে দেখছি। তবে আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়েছি। তিনি যদি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে থাকেন, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা : সাংবাদিক কে হুমকির বিষয়ে বলেন সাংবাদিক তথ্য চাওয়ায় উনি যে সাংবাদিককে মামলা করার হুমকি দিয়েছেন এটার বিষয়ে উনি আমাকে অবহিত করেন নি।আমি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেই বিষয়টি জেনেছি। বিষয়টি জানার পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। তিনি চাকরির শৃঙ্খলা ভংগ করে থাকলে পরবর্তীতে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে—উপজেলার শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়েও এত গুরুতর ঘটনায় কেন তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? জনমনে এ নিয়ে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী, কোনো নাগরিক তথ্য চাইলে তার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ নেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ প্রকৌশলী সাবরীন মাহফুজ একজন সাংবাদিককে মামলা করার হুমকি দিয়ে স্পষ্টভাবে আইন লঙ্ঘন করেছেন।
এই আইনের ধারা ২৬(১)-এ বলা আছে:“তথ্য চাওয়ার কারণে কোনো নাগরিককে ভয়ভীতি, হয়রানি বা কোনো ক্ষতিকর পদক্ষেপের মুখোমুখি করা যাবে না।”
এছাড়া সরকারি ভবনের কক্ষ বরাদ্দে উপজেলা কক্ষ বরাদ্দ কমিটি একমাত্র বৈধ কর্তৃপক্ষ। ইউএনও সভাপতি, আর সদস্য হিসেবে উপজেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন। এককভাবে এলজিইডি প্রকৌশলীর এই দখলদারি ও স্টিকার লাগানো প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সাবরীন মাহফুজের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে জানানো হয়—তিনি বিষয়টি সংবাদমাধ্যম থেকেই জেনেছেন।তবে তিনি নিজের বক্তব্য অস্বীকার করেননি, ক্ষমা চাননি বা সাংবাদিকদের সম্মান জানিয়ে কোনো ব্যাখ্যাও দেননি, যা ঘটনার গাম্ভীর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
লালমাইয়ের সাংবাদিক, সুশীল সমাজ ও সচেতন নাগরিকরা এই ঘটনায় চরম ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে—“সরকারি কক্ষ নিজের মালিকানায় নিয়ে বসার মানসিকতা, ইউএনওকে অবজ্ঞা, এবং সাংবাদিকদের হুমকি—এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া ভবিষ্যতে সাংবাদিকদের জানার অধিকারই অস্বীকৃত হয়ে যাবে।”তারা জোরালোভাবে দাবি জানান—অভিযুক্ত প্রকৌশলীর দায়িত্ব থেকে সাময়িক বরখাস্ত,জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্বতন্ত্র তদন্ত কমিটি গঠন,তথ্য অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ,সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও তথ্য অধিকার রক্ষা নিশ্চিতে প্রশাসনিক নির্দেশনা
সরকারি ভবনের বরাদ্দ নিয়ে দখলদারিত্ব, সাংবাদিকদের হুমকি, এবং ইউএনওর চুপ করে থাকা—সব মিলিয়ে প্রশাসনিক কাঠামোর ভিত নড়ে উঠেছে।
এই ঘটনা ক্ষমতার দম্ভ ও স্বেচ্ছাচারিতার বিপজ্জনক উদাহরণ, যা অবিলম্বে দমন করা না হলে ভবিষ্যতে সাংবাদিক ও নাগরিকদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও তথ্যের স্বাধীনতা বজায় রাখতে এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত, কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে—এটাই এখন সময়ের সবচেয়ে জোরালো দাবি।