
মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার
রাজনীতি ও আদর্শের নামে ঢাকায় গড়ে উঠেছে নতুন এক ‘নির্যাতনের ঘাঁটি’। রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অফিসকে ঘিরে ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে—যা শুনে স্তব্ধ সাধারণ মানুষ, উদ্বিগ্ন সচেতন মহল, এবং নড়েচড়ে বসেছে গণমাধ্যমকর্মীরা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশ টিভির একটি অনুসন্ধানী ভিডিও রিপোর্টে উঠে এসেছে, এই অফিসটি যেন রূপ নিয়েছে এক টর্চার সেলে। সেখানে একজন নিরীহ ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের পর ব্ল্যাঙ্ক চেক ও সাদা স্ট্যাম্পে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির ঢাকা মহানগরের যুগ্ম আহবায়ক সাদমান সানজিদ ও রিফাতুল হক শাওনের বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্গে ছিলেন শাহ আলী থানার সদস্য সচিব পারভেজসহ ৮ থেকে ১০ জন সদস্য।
ভিডিও ফুটেজ এবং একাধিক ভুক্তভোগীর বক্তব্যে জানা যায়, অভিযুক্ত এসব যুবক নিজেরা এনসিপি (জাতীয় ছাত্র পরিষদ)-এর আহবায়ক নাহিদ ইসলাম-এর ছোট ভাই পরিচয়ে মিরপুর ও আশপাশের এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।তারা নিজেদের পরিচয় প্রমাণ করতে নাহিদ ইসলামের সঙ্গে তোলা একাধিক ঘনিষ্ঠ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে। এমনকি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের দেখিয়ে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা, বদলি, নিয়োগ কিংবা পদায়ন আদায় করতে মরিয়া আচরণ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে সাংবাদিকরা যান মিরপুরে অবস্থিত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে। যদিও তিনি ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি, তবে অফ-দ্য-রেকর্ড স্বীকার করেছেন যে, কিছু যুবক নিজেকে নাহিদ ইসলামের আত্মীয় দাবি করে প্রভাব বিস্তার করে নানা বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করেছেন।
তিনি বলেন, “ঘনিষ্ঠ ছবি দেখিয়ে বদলিসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করে কিছু ব্যক্তি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা পরিপন্থী।”ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী জানান, “আমাকে একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। চোখ বেঁধে মারধর করে। পরে বলল, চেক ও স্ট্যাম্পে সই না দিলে ভিডিও ছড়িয়ে দেবে।” এমনকি এই নির্যাতনের সময় অফিসে উচ্চস্বরে রাজনৈতিক স্লোগান ও ভয়ভীতিমূলক বক্তব্য শোনা যায়।
সাংবাদিকরা ভিডিও ফুটেজে যেসব দৃশ্য দেখেছেন, তা একেবারেই মাফিয়াচক্রের অপকর্মের সঙ্গে তুলনীয়। অভিযোগ রয়েছে, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, এমনকি চাকরিপ্রার্থী যুবকদের টার্গেট করে জালিয়াতি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্রটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, “ছাত্র রাজনীতির আদর্শ যখন অপরাধচক্রে পরিণত হয়, তখন তা গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।”
বিশিষ্ট সাংবাদিকরা বলেন, “নামসর্বস্ব সংগঠন, মিথ্যা রাজনৈতিক পরিচয় এবং দলে ঘনিষ্ঠতা দেখিয়ে প্রভাব বিস্তার আজকাল এক মহামারিতে রূপ নিয়েছে।”
তারা আরও বলেন, “এই চক্র শুধু যে নিরীহ মানুষদের ক্ষতি করছে তা নয়, বরং প্রকৃত ছাত্র আন্দোলন ও রাজনীতির ভাবমূর্তিকে ধ্বংস করছে। সরকারের উচিত এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া।”
১. অবিলম্বে ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার।
২. ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও ক্ষতিপূরণ প্রদান।
৩. নাহিদ ইসলাম ও তার পরিচয়ের অপব্যবহার নিয়ে তদন্ত।
৪. রাজনৈতিক পরিচয়ের অপপ্রয়োগ বন্ধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন।
৫. ছাত্র রাজনীতির নামে গঠিত অপরাধ চক্র ও ভূঁইফোঁড় সংগঠনের নিবন্ধন ও তদারকি করা।
ছাত্র আন্দোলন দেশের পরিবর্তনের হাতিয়ার হওয়ার কথা, কিন্তু যখন তা হয়ে ওঠে নির্যাতন, ভয়ভীতি ও জালিয়াতির অস্ত্র—তখন সেটিকে আর রাজনীতি বলা যায় না, বরং তা হয়ে পড়ে রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধচক্র। মিরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে পরিচালিত এই কর্মকাণ্ড এখনই দমন না করলে ভবিষ্যতে এর ভয়াবহতা আরও বিস্তৃত হতে পারে।
এই ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সচেতন সমাজের উচিত একসাথে দাঁড়িয়ে এমন অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলা।