
মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার
ইসলামের ইতিহাসে এমন এক ধারা রয়েছে, যা বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের হৃদয়ের গভীরতম স্তরে পৌঁছাতে চায়—এই ধারার নামই সুফীজম বা সুফীবাদ। এটি এমন এক আধ্যাত্মিক জীবনপথ, যা মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর প্রেমে নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার শিক্ষা দেয়। বাংলাদেশের মাটিতে এই সুফী দর্শনের ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহু দরবার ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। তবে এদের মধ্যে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার অন্তর্গত মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ একটি উজ্জ্বলতম নাম, যা শুধু একটি দরবার নয়—একটি চলমান আধ্যাত্মিক বিপ্লব, একটি জীবন্ত সুফী আন্দোলন।
সুফীবাদ: ইসলামের হৃদয়কেন্দ্রিক ব্যাখ্যা
সুফীবাদ কোনো নতুন ধর্ম নয়, বরং ইসলামের আধ্যাত্মিক অনুশীলনের একটি ঐতিহ্যবাহী শাখা। এটি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে গঠিত এমন এক জীবনদর্শন, যেখানে বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি আত্মিক অনুশীলন গুরুত্ব পায়।
সুফীরা বিশ্বাস করেন—আল্লাহর প্রেমই সর্বশ্রেষ্ঠ সত্য এবং সেই প্রেম লাভের জন্য প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি, অহংকারবর্জন ও অন্তরংগ ধ্যান।
সুফীবাদের মূল উপাদানসমূহ হলো: জিকির: আল্লাহর নামের স্মরণে আত্মাকে প্রশান্ত করা।মুরাকাবা: ধ্যানমগ্নতার মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করা।ফানা ফিল্লাহ: নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে আল্লাহর অস্তিত্বে মিলিত হওয়া। ইনসানে কামেল অনুসরণ: এমন এক পীর বা আধ্যাত্মিক গুরু যার মাধ্যমে মুরিদ আত্মিক উন্নয়নে এগিয়ে যেতে পারে।
মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ: এক অমূল্য আধ্যাত্মিক আলোকস্তম্ভ বাংলাদেশে সুফীবাদের বিকাশে হযরত সৈয়্যদ আহমদ উল্লাহ (ক.) প্রতিষ্ঠিত মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি শুধু একজন সুফী সাধকই ছিলেন না, বরং একাধারে আল্লাহপ্রেমিক, মানবদরদি, সমাজসংস্কারক ও আধ্যাত্মিক বিপ্লবের দিকনির্দেশক ছিলেন। তাঁর আদর্শ ও দর্শনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে মাইজভাণ্ডারী তরিকা—যা মূলত ইসলামি সুফীবাদের উপমহাদেশীয় রূপান্তর।
মাইজভাণ্ডারী দর্শনের মূলনীতি :আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গঠনে আত্মশুদ্ধি
এই দরবারে জিকির, দোয়া, মুরাকাবা, মিলাদ, ফাতেহা—সব কিছুই আত্মার খোরাক হিসেবে দেখা হয়।,ইনসানে কামেল-এর মাধ্যমে ইলহাম ও হেদায়েত প্রাপ্তি
মাইজভাণ্ডারী তরিকায় পীরকে শুধুমাত্র একজন গাইড নয়, বরং আত্মিক উন্নয়নের মাধ্যম ও আল্লাহর রহমতের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।,মানবতা ও সেবাধর্মিতা
দরিদ্র, নিপীড়িত ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো—মাইজভাণ্ডার দরবারের ধর্মীয় দায়বদ্ধতার একটি প্রধান দিক। এখানে ধর্মীয় অনুশীলনের পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড চালু রয়েছে। উচ্চতর আদর্শে আল্লাহর প্রেমে আত্মবিলীনতা
“আল্লাহর প্রেমই পরম সত্য”—এই নীতিতে বিশ্বাসী মাইজভাণ্ডার দরবারের অনুসারীরা ইবাদতের মাধ্যমে নয়, প্রেমের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য খোঁজেন।
আধুনিক বিশ্বে মাইজভাণ্ডার দরবারের প্রাসঙ্গিকতা,যেখানে আধুনিক সমাজ আত্মকেন্দ্রিকতা, ভোগবাদ ও ধর্মীয় সহিংসতায় জর্জরিত, সেখানে মাইজভাণ্ডার দরবারের মতো আধ্যাত্মিক কেন্দ্রগুলো আজও দয়া, সহানুভূতি, ক্ষমা, সহনশীলতা এবং অন্তরের শান্তি শেখায়। এই দরবার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত—যেখানে একমাত্র শর্ত হলো ভালোবাসা ও আত্মসমর্পণ।
আজকের সময়ে যখন মুসলিম জগৎ বিভাজনের শিকার, তখন মাইজভাণ্ডারী দর্শনের এই আহ্বান বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ—“মানবতার জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য নয় মানবতা।”
সুফীজম কোনো জটিল তত্ত্ব নয়, এটি এক সহজ সরল হৃদয়ের প্রেমময় পথ, যেখানে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ও তাঁর সৃষ্টি মানবজাতির প্রতি সহানুভূতি রয়েছে। মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ এই সুফীধারার এক উজ্জ্বল পথিকৃৎ। তারা শুধু ধর্মের নয়, আত্মার বিপ্লব ঘটায়।এই দরবার আমাদের শেখায়—আল্লাহর নৈকট্য কেবল নামাজ, রোজা, হজের মাধ্যমেই নয়; বরং সেবার মাধ্যমে, ভালোবাসার মাধ্যমে, ক্ষমা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
আজও যারা আল্লাহর প্রেমে আত্মাকে বিলীন করতে চান, যারা একটি শান্তিপূর্ণ ও দয়ালু সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন—তাদের জন্য মাইজভাণ্ডার দরবার এক অফুরন্ত আধ্যাত্মিক আলোর উৎস।