কুরবানীর ফজিলত কাজী মুহাম্মদ আল – ইমরান

কুরবানীর ফজিলত কাজী মুহাম্মদ আল – ইমরান
প্রভাষক আরবি বাকশীমূল সুন্নিয়া ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসা।

মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও আদেশ অনুগত পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের আত্মত্যাগের মহান স্মৃতি বিজড়িত কুরবানি।

আল্লাহর আদেশে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আপন পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কুরবানি করার ঘটনাকে স্বরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিমরা এই দিবসটি পালন করে। আরবি ‘কুরবান’ শব্দটি উর্দু বা ফারসিতে ‘কুরবানি’ রূপে রূপান্তরিত হয়েছে। যার অর্থ সান্নিধ্য, নৈকট্য। আর ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবাতুন’ শব্দ থেকে নির্গত। আরবি ‘কুরবান’ ও ‘কুরবাতুন’ উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ সান্নিধ্য লাভ করা, নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ করা। ইসলামী শরিয়ার পরিভাষায় কুরবানি ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন ও তাঁর ইবাদতের জন্য হালাল কোন জন্তু যবেহ করা হয়। (মুফরাদাত: ইমাম রাগিব, আল-কামুসূল মুহিত)

 

আত্মত্যাগ, আত্মউৎসর্গ, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী, স¤প্রীতি, ভালবাসা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও সর্বোপরি মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের সুমহান মহিমায় চিরভাস্বর কুরবানি। কুরবানি মুসলিম জীবনের ইবাদতের এক তাৎপর্যপূর্ণ গৌরবের উৎস। মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক যুগে যুগে প্রেরিত অসংখ্য নবী-রাসুল আলাইহিমুস সালামকে অনেক কঠিন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং তাঁরা সকলেই এতে কামিয়াবও হয়েছেন কৃতিত্বের সাথে। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম, যিনি প্রতিটি পরীক্ষায় পাহাড়সম ধৈর্য্য ও ত্যাগের মাধ্যমে কৃতকার্য হয়েছিলেন।

এ সম্পর্কে কুরআনুল করীমে এরশাদ হয়েছে: “(হে হাবীব! আরও স্মরণ করুন) যখন ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) কে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি (আল্লাহ তা’লা) বললেন, আমি তোমাকে মানব জাতির ইমাম হিসাবে চয়ন করে নিলাম। তিনি (হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম) বললেন, আমার ভবিষ্যৎ বংশধরও তা পাবে, তিনি (আল্লাহ তা’লা) বললেন, আমার এ প্রতিশ্রæতি যালিমরা পাবেনা’’ (বাকারাহ-১২৪)

আল্লাহ তাআলা কুরআনে এ ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে:
“অতঃপর তিনি (হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম) যখন পিতার (হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম) সাথে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলেন তখন ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) বললেন, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি তোমাকে কুরবানী করছি, এখন তোমার অভিমত কী? তিনি (হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম) বললেন, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় অচিরেই আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’ (সূরা সাফফাত-১০২)
কুরবানির যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা হলো। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম পুত্রকে শুইয়ে কুরবানি করার উদ্যোগ নিতেই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ‘ইবরাহিম থামো’ বলে আওয়াজ এলো। আর তখন কুদরতিভাবে আসা একটি দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল। হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর আদেশ পালনে সফল হলেন। পুত্রকে কুরবানি করার সিদ্ধান্ত ও আয়োজনে আল্লাহ খুশি হলেন। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কুরবানি প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের বাণী:

“দুজনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিলেন আর ইবরাহিম তাকে কাত করে শুইয়ে দিলেন। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমিতো স্বপ্নকে সত্য প্রমাণিত করে দেখালে। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবানির বিনিময়ে তাকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর আমি তাকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয করে রাখলাম।’’ (সূরা সাফ্ফাত-১০৩-১০৮)
হযরত যাইদ বিন আরকাম রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু সূত্রে বর্ণিত, একদা কতেক সাহাবি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আরয করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! কুরবানি কী? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের পিতামহ হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এর সুন্নাত। তাঁরা পুনঃজিজ্ঞাসা করেন, এতে আমাদের ফায়দা কী? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কুরবানির পশুর প্রতিটি লোমের বিনিময়ে তোমাদের জন্য রয়েছে একটি করে নেকি।’ (ইবনে মাজাহ, কিতাবুল আদ্বাহী, বাবু সাওয়াবুল্ উদ্বহিয়্যাহ, হা-৩১২৭)।

কুরবানীর মূল প্রাণ হল ইখলাস:

হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের আত্মত্যাগ ও আল্লাহ প্রেমের মহিমাকে স্মরণ করেই ঈদুল আযহায় কুরবানির উৎসব পালন করা হয়। দুনিয়ার প্রতিটি সঙ্গতিপূর্ণ, সামর্থ্যবান মুসলমান এ দিনটিতে আত্মত্যাগের উদাহরণ স্বরূপ পশু কুরবানি করে থাকে। কুরবানীর প্রাণ কথা হল তাকওয়া-খোদাভীতি, আল্লাহর প্রতি নিখুঁত মহব্বত ও আল্লাহর রাহে নিজের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করা। তবে আল্লাহর নিকট পশুর রক্ত, গোশত কিছুই পৌঁছে না। তাঁর নিকট পৌঁছে মানুষের তাকওয়া বা প্রভুভক্তি। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের থেকেই কবুল করে নেন।” (সূরা মায়িদা:২৭) তিনি আরো বলেন: “আল্লাহর কাছে না এসব (কুরবানিকৃত) পশুর গোশত পৌঁছে, না তার রক্ত; বরং তার নিকট তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে থাকে।” (সূরা হজ্ব : ৬৭) আল্লাহ বলেন:
“বলুন, আমার সলাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তাঁর কোন শরীক নাই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি আর আমিই প্রথম মুসলিম।” (সূরা আনআমঃ ১৬২-১৬৩)
এই কারণেই পূর্ণ ইখলাস ও মুহাব্বতের সাথে শুধুই আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেযামন্দীর জন্য কেউ কুরবানী করলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। লোক দেখানো কুরবানি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তা কবুল হওয়ার কথা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। (জামে তিরমিযী হাদীস : ১৪৯৩ )

কোরবানির বিধান:
কুরবানি করা ওয়াজিব। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার নবীকে কুরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন- “আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুণ ও কুরবানি করুণ।” (সূরা কাওসার: ০২) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে মানবমন্ডলী! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হল প্রতি বছর কুরবানি করা।’’ (তিরমিযী, হা-১৫১৮) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারেও না আসে।’’ (ইবনে মাজাহ,৯/২৭৬, হা-৩১১৪. মুসনাদে আহমদ ১৬/৪৬৬ মুসতাদরাক ১৭/৪২৪. বায়হাক্বী: শুয়াবুল ইমান, ১৫/৩৮২, হা-৭০৮৩)

যার ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব:
যে ব্যক্তির নিকট নিম্নোক্ত শর্তাবলী পাওয়া যাবে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব। ১. মুসলিম হওয়া: অমুসলিম ব্যক্তির ওপর শরিয়তের এ বিধান প্রয়োজ্য নয়। ২. স্বাধীন হওয়া: গোলাম বা দাস-দাসীর ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। ৩. মুকিম হওয়া: মুসাফিরের ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। ৪. সামর্থ্যবান বা ধনী হওয়া: গরীব বা মিসকিনের ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়।

১০ই জিলহজে¦র ফজর থেকে ১২ই জিলহজে¦র সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ কুবানির দিনগুলোতে যার নিকট যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পরিমান অর্থ সম্পদ থাকে তবে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব হবে। উল্লেখ্য যে, কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নেই বরং কুরবানির দিন ব্যয়ের উদ্ধৃত, নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুর অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব। দৈনন্দিন প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মালিককে নিসাবের মালিক বলা হয়।

কুরবানি ওয়াজিব না হলেও নফল কুরবানি করলে কুরবানির সওয়াব পাওয়া যাবে। কোন উদ্দেশ্য পুরনের ভিত্তিতে কুরবানির মান্নত করলে যদি সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায় তবে তার জন্য কুরবানি ওয়াজিব হয়ে যায়। যার উপর কুরবানি ওয়াজিব সে কুরবানির দিনগুলোতে কোন বিশেষ কারণে কুরবানি করতে না পারলে পরে একটা বকরির দামের সমপরিমান মূল্য সদকাহ করে দিতে হবে।
কুরবানীর সময়: কুরবানি নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত একটি ইবাদত। এ সময়ের পূর্বে যেমন কুরবানি আদায় হবে না তেমনি পরে করলেও আদায় হবে না। ঈদের সালাত আদায় করার পর থেকে কুরবানির সময় শুরু হয়। হযরত বারা ইবনু আ’যেব রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশে বললেন: “আমাদের এই দিবসে প্রথম কাজ নামায আদায় করা, এরপর কুরবানী করা। সুতরাং যে এভাবে করবে তার কাজ আমাদের তরীকা মতো হবে। আর যে আগেই যবেহ করেছে (তার কাজ তরীকা মতো হয়নি) অতএব তা পরিবারের জন্য প্রস্তুতকৃত গোশত, (আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত) কুরবানী নয়।“ (সহীহ বুখারী ২/৮৩২; সহীহ মুসলিম ২/১৫৪) আর কুরবানির সময় শেষ হবে জিলহজ্জ মাসের ১২ তারিখ আসর পর্যন্ত ।

কুরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী:
১. এমন পশু দ্বারা কুরবানি দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হল গরু, উট, মহিষ, ছাগল, দুম্বা, ভেড়া। কুরআনের পরিভাষায় এগুলোকে ‘বাহীমাতুল আনআম’ বলা হয়।
২. শরিয়তের দৃষ্টিতে পশুর নির্দিষ্ট বয়স হতে হবে। যেমন উট পাঁচ বছরের হওয়া, গরু বা মহিষ দুই বছরের হওয়া, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল এক বছরের হওয়া।
৩. কুরবানির পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। চার ধরনের পশু দিয়ে কুরবানি জায়েয হবে না। অন্ধ, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত, যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত, যার কোন অংগ ভেঙ্গে গেছে।
৪. ত্রুটিযুক্ত পশু দিয়ে কুরবানি করলে তা মাকরূহ হবে। যেমন শিং ভাঙ্গা, লেজ কাটা, কান কাটা ইত্যাদি। গুণগত দিক দিয়ে উত্তম কুরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুত ও দেখতে সুন্দর হওয়া।
যে ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী হয় না:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “চার ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী করা যায় না: যে পশুর এক চোখের দৃষ্টিহীনতা স্পষ্ট, যে পশু অতি রুগ্ন, যে পশু সম্পূর্ণ খোড়া এবং যে পশু এত শীর্ণ যে, তার হাড়ে মগজ নেই।”

কুরবানীর পশুর গোশত-চামড়া:

কুরবানির পশুর অংশ (গোশত, চর্বি, দড়ি, চামড়া ইত্যাদি) বিক্রয় করা বৈধ হবে না। কারণ, তা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত বস্তু। তাই কোনভাবেই পুনরায় তা নিজের ব্যবহারে ফিরিয়ে আনা বৈধ নয়। চামড়া বিক্রিত অর্থ সাদকা করে দিতে হয় এবং কুরবানীর পশুর কোনো অংশ কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়া নিষেধ। তার পারিশ্রমিক নিজের পক্ষ থেকে দিতে হয়। (সহীহ বুখারী ১/২৩২; সহীহ মুসলিম ১/৪২৩-৪২ ৪)
কুরবানির গোশত বণ্টন:
কুরবানির গোশত বণ্টন ও খাওয়া সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, অতঃপর তোমরা তা হতে আহার কর এবং দুস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।” (সূরা হজ্জ-২৮)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন: “তখন তা হতে তোমরা খাও এবং হতদরিদ্র ও যাচনা উভয় ধরনের অভাবগ্রস্তকে খাওয়াও।” (সূরা হজ্ব : ৩৬) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,“তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর।” (সহীহ মুসলিম, হা-২৫৫০) উলামায়ে কেরাম কুরবানির গোশ্ত তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ নিজের, এক ভাগ দুস্থ, গরিব, অভাবীদের জন্য দান করা এবং অপর ভাগ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীকে উপহার দেয়া মুস্তাহাব বলেছেন। কুরবানির গোশ্ত যতদিন ইচ্ছা সংরক্ষণ করা যাবে। তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ করা যাবে না বলে যে হাদীস রয়েছে তার হুকুম রহিত।

শরিক কুরবানীতে গোশত ওজন করে বন্টন করা:

গরু, মহিষ, উট কুরবানীতে কাউকে শরিক করলে গোশত ওজন করে বন্টন করাই বাঞ্ছনীয়, অনুমান করে নয়। হতে পারে কেউ বেশি বা কম পাবে তবে তা নাজায়েয।
মৃত ব্যক্তির পক্ষে কুরবানি: কুরবানি মূলত যথাসময়ে জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অবশ্য ইচ্ছা করলে তার মৃত পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকেও কুরবানি করা যেতে পারে। এটা জায়েয ও সওয়াবের কাজ। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণ নিজেদের এবং পরিবার-পরিজনদের পক্ষ থেকে কুরবানি করতেন। কুরবানি একটি সদকা। মৃত ব্যক্তির জন্য সদকা ও কল্যাণমূলক কাজ প্রয়োজন ও এটা তাদের জন্য উপকারী। হাদীস শরীফে এসেছে হযরত আবু রাফে’ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কুরবানি দিতে ইচ্ছা করলেন তখন দুটি দুম্বা ক্রয় করলেন, যা ছিল বড়, হৃষ্টপুষ্ট, শিংওয়ালা, সাদা-কাল বর্ণের এবং খাসি। তিনি ঈদগাহে থাকাবস্থায় একটি আনা হলে তিনি এটিকে তাঁর ও তাঁর ঐ উম্মতের জন্য কুরবানি করলেন, যারা আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর রাসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে, আর অন্যটি তাঁর নিজের এবং তাঁর পবিত্র বংশধর ও পরিবারবর্গের জন্য কুরবানি করেন। (মুসনাদে আহমদ, হা-২৬৫৫৫)
অনেক সময় দেখা যায় ব্যক্তি নিজেকে বাদ দিয়ে তার মৃত বা জীবিত মা-বাবার পক্ষে কুরবানি করেন। এটা মোটেই ঠিক নয়। যার উপর কুরবানি ওয়াজিব সে তার বাবা-মা বা অন্য কারো জন্য কুরবানি করলেও তার কুরবানির ওয়াজিব আদায় হবে না ।

কুরবানীর একাংশে আক্বীকা দেওয়া প্রসঙ্গ:

কুরবানীর সময় আমরা আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত আমল দেখতে পাই, তা হচ্ছে, গরু কিংবা উট কুরবানী দেয়ার সময় তাতে সন্তানের আক্বীকা দেওয়া। হানাফী, শাফেয়ী এবং হাম্বালী মাযহাবের বর্ণনা অনুযায়ী এই রকম করা জায়েয। শর্ত হচ্ছে, সকল অংশীদারের নিয়ত যেন আল্লাহর নৈকট্য হয়, গোস্ত খাওয়া কিংবা অন্য উদ্দেশ্য না হয়। [ফাতাওয়া হিন্দিয়্যাহ,৫/৩০৪, বাদাইউস্ সানাঈ,৫/৭২]

কুরবানীর একাংশ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য দেওয়া:

উল্লেখ থাকে যে, সামর্থ্যবান ব্যক্তির উচিৎ নিজের কুরবানির পাশাপাশি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার নামে কুরবানি করা, কেননা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো নিজের কুরবানির মূহুর্তে স্বীয় উম্মতদেরকে বাদ দেননি। তিনি দুটি ছাগল দ্বারা কুরবানি প্রদান করতেন একটি নিজের পক্ষে, আরেকটি সকল উম্মতের পক্ষে কুরবানি প্রদান করতেন। এটা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার বৈশিষ্ট্য। বরং একভাগ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার নামে হওয়ার কারনে সকলের পক্ষ থেকে আদায় করা কুরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যাবে।

দু’জনে মিলে একটি গরু বা মহিষ কুরবানির জন্য ক্রয় করলে উভয়ে তিন ভাগে ভাগ করে নেওয়ার পর অবশিষ্ট এক ভাগকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার জন্য নির্ধারন করা হলে তাও শরীয়ত সম্মত তথা জায়েয এবং উক্ত ভাগের গোশত সবাই ভাগ করে নেবে। আর যদি এক জন উক্ত ভাগের খরচ সম্পূর্ণ বহন করে তবে সে উক্তভাগের গোশত সবগুলো নেবে। অনুরুপভাবে তিন জন মিলে করলেও সবাই উক্ত ভাগে শরীক হতে পারবে এবং গোশত সে অনুপাতে ভাগ করে নেবে। উক্ত ভাগে কয়েকজন টাকা দিয়ে শরীক হলেও ভাগটা এক সত্তার নামে হওয়ার কারনে শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানি অশুদ্ধ হবে না।

কুরবানীর টাকা দিয়ে দুস্থ মানবতার সাহায্য ও শরীয়তের বিধান:

কুরবরনী একটি অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত, কুরবানীর টাকা দিয়ে দুস্থদের সাহায্যের নামে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও নিদর্শনকে অবজ্ঞা করা যায় না। যদি কুরবানীর টাকা দিয়ে দুস্থদের সাহায্যের বিধান থাকতো তা’হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাগন তাই করতেন, কিন্তু করেননি বরং দূর্ভিক্ষ ও অভাব-অনটনের সময়ও কুরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কুরবানির গোশ্ত তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ না করে দুস্থ ও অভাবীদের মধ্যে বন্টন করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কুরবানীর অর্থ দান করার নির্দেশ দেন নি।

বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত রয়েছে:
হযরত সালামাহ ইবনু আকওয়া’ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ তোমাদের যে লোক কুরবানী করেছে, সে যেন তৃতীয় দিনে এমন অবস্থায় সকাল অতিবাহিত না করে যে, তার ঘরে কুরবানীর গোশ্ত কিছু থেকে যায়। পরবর্তী বছর আসলে, সাহাবীগণ আরয করলেনঃ হে আল্লাহ্র রসূল! আমরা কি তেমন করব, যেমন গত বছর করেছিলাম? তখন তিনি এরশাদ করলেনঃ তোমরা নিজেরা খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং সঞ্চয় করে রাখ, কারণ গত বছর মানুষের মধ্যে ছিল অভাব-অনটন। তাই আমি চেয়েছিলাম, তোমরা তাতে সহযোগিতা কর।[বুখারী-৫২৪৯, মুসলিম হা-৩৬৪৬ ৩৫/৫, হাঃ ১৯৭৪] আধুনিক প্রকাশনী- ৫১৬২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫০৫৮)
আল্লাহ তায়ালা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঠিকভাবে আমল কারার তাওফিক দান করুক আমিন।