সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় খালাস পেলেন সাংবাদিক শফিক রেহমান

মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার

বাংলাদেশের আলোচিত ও বহুল বিতর্কিত একটি মামলায় আজ এক ঐতিহাসিক রায় ঘোষিত হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় প্রবীণ সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী শফিক রেহমানকে খালাস দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে বিচারক আজ রায়ে জানান—এ মামলায় শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি।

আজ মঙ্গলবার (২৭ মে) ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ তারিক এজাজের আদালত এ রায় দেন। রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন ৯০ বছর বয়সী সাংবাদিক শফিক রেহমান, যিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এক বিশিষ্ট ও প্রভাবশালী নাম।

শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষ স্পষ্ট ভাষায় আদালতকে জানায়, তারা শফিক রেহমানের খালাসের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি রাখে না। অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ খলিলুর রহমান বলেন, “এটা একটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা। তিনি একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক, আদালত চাইলে তাকে খালাস দিতে পারে।”

অন্যদিকে আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেসবাহ বলেন, “এ মামলায় কোনো ভিকটিম স্বয়ং মামলা করেননি। পুলিশ অতিরিক্ত আগ্রহ নিয়ে মামলা দায়ের করেছে। এমনকি মামলায় কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও নেই। ১২ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন, এমনকি জয়ও সাক্ষ্য দিয়েছেন—কিন্তু মামলার মূল কাঠামো ভঙ্গুর।”

২০১৫ সালের ৩ আগস্ট ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফজলুর রহমান রাজধানীর পল্টন থানায় এই মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ ছিল, বিএনপি ঘনিষ্ঠ একটি গোষ্ঠী—যার মধ্যে সাংবাদিক শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান, জাসাস নেতা মোহাম্মদ উল্লাহ মামুন, রিজভী আহমেদ সিজার ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মিজানুর রহমান ভূঁইয়া জড়িত—যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় একত্র হয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্র করেন।

২০১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। পরে ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকার একটি আদালত তাদের বিরুদ্ধে দুই ধারায়—৩৬৫ (অপহরণ) ও ১২০-খ (ষড়যন্ত্র)—মোট সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। সাজার বিরুদ্ধে আপিলের প্রেক্ষিতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শফিক রেহমান ও মিজানুর রহমানের সাজা এক বছরের জন্য স্থগিত করে। শফিক রেহমান জামিনে মুক্তি পান এবং পরে নিয়মিত আপিল দায়ের করেন।

শফিক রেহমানের আগে এই মামলায় খালাস পেয়েছেন দৈনিক “আমার দেশ” পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। গত ১০ ফেব্রুয়ারি আদালত তাকে নির্দোষ ঘোষণা করেন। এ রায়ের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে মামলাটির আইনি ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে বলে আইনজীবীরা অভিমত দেন।

প্রথম থেকেই এই মামলা ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেকেই অভিযোগ তোলেন, মামলাটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে উদ্ভূত। সাংবাদিক শফিক রেহমান দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ-বিরোধী লেখালেখির জন্য পরিচিত ছিলেন। ফলে তার গ্রেপ্তার ও মামলার বিষয়টিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে বিবেচনা করা হয়েছিল।

শুনানিতে শফিক রেহমানের আইনজীবী বলেন, “যেদিন জয় সাক্ষ্য দিলেন, সেদিন বিচারক তার পেছনে দৌঁড়াচ্ছেন—এমন চিত্রও আমরা আদালতে দেখেছি। তাহলে বুঝুন, এ মামলার বিচার কতটা রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল।”

শফিক রেহমানের খালাস দেশের গণমাধ্যম, সাংবাদিক সমাজ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে এক আশার বার্তা হয়ে এসেছে। প্রবীণ এই সাংবাদিকের মুক্তিকে অনেকেই ‘গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিজয়’ হিসেবে দেখছেন।

গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই রায় ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে—যেখানে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর উত্থাপিত অভিযোগও প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত না হলে আদালত ন্যায়বিচার নিশ্চিতে নিষ্কণ্টক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

একজন প্রবীণ সাংবাদিক, যার বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই, যার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে বহুবার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছে—তার বিরুদ্ধে এমন একটি গুরুতর অভিযোগ থেকে খালাস পাওয়া শুধু ব্যক্তিগত মুক্তি নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি এক অনন্য বার্তা।