মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রথম মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির খালাসের নজির স্থাপন করলো আপিল বিভাগ

মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী নজির স্থাপিত হলো। মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পেলেন। এতে করে দেশের আইনি ও বিচারিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো, যা আইনজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

মঙ্গলবার (২৭ মে), প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে আজহারুল ইসলামকে খালাস দেন। এ রায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ২০১৪ সালের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে তাকে সকল অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি রংপুর অঞ্চলে সংঘটিত ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের নেতৃত্ব দেন। মামলার রায়ে বলা হয়েছিল, তিনি:

  • ১২৫৬ জন নিরীহ মানুষকে হত্যার ঘটনায় জড়িত,

  • ১৭ জনকে অপহরণ ও একজনকে ধর্ষণে অংশ নেন,

  • ১৩ জনকে আটক ও নির্যাতন করেন,

  • শতাধিক বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন।

এই সকল অভিযোগের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রাখে।

তবে এখানেই শেষ হয়নি আইনি লড়াই। আজহারুল ইসলাম রিভিউ আবেদন করেন, যা ২০২৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শুনানির জন্য গৃহীত হয়। দীর্ঘ শুনানি শেষে আজ মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাকে খালাস দিয়ে বলেন, “দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রমাণের ঘাটতি ছিল এবং সাক্ষ্য-প্রমাণে গুরুতর অসঙ্গতি রয়েছে।” এ রায়ে তার মুক্তির পথ সুগম হলো।

আজহারুল ইসলামের আইনজীবীরা রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এ রায় প্রমাণ করে যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিরপেক্ষভাবে আইন ও প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার করেন।”

অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা রায়কে ‘বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতার প্রতিফলন’ বলে মন্তব্য করলেও, অনেকে এই রায়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, গণহত্যার মতো গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত একজন ব্যক্তির খালাস দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত হানতে পারে।

এই রায় জামায়াত-ই-ইসলামীসহ দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এক নতুন গতিপথ তৈরি করতে পারে। একদিকে এটি আইনের শাসনের শক্তিশালী বার্তা দিতে পারে, অন্যদিকে রায় নিয়ে বিভক্তি ও রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হওয়াও অনিবার্য।

রায়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যায়নি। তবে রাজনৈতিক মহলে এর প্রতিক্রিয়া গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

এটি শুধু একটি মামলার রায় নয়, বরং একটি বিচারিক ও ইতিহাসিক সিদ্ধান্ত—যা ভবিষ্যতে দেশের আইনি কাঠামো, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও মানবাধিকার চর্চার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে খালাস দেওয়ার ঘটনা ইতিহাসে প্রথম, যা আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সাক্ষ্য-প্রমাণের গুরুত্ব এবং বিচারিক স্বচ্ছতার বিষয়গুলো আবারও সামনে এনেছে।