
মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার
সামাজিক মাধ্যমে বরাবরের মতো সরব ও সচেতন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর এবার রাজনীতির উত্তাল ধারায় এক সাহসী মন্তব্য করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন। দেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন বিএনপির অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব সংকট ও বিভাজন নিয়ে। তার ভাষায়, “বিএনপির একটি অংশ শেখ হাসিনার মতো দম্ভিকতার ফাঁদে আটকে পড়েছে।” এই বক্তব্য যে কেবল মাত্র একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ নয়, বরং গভীর রাজনৈতিক অসন্তোষ এবং জাতীয় নেতৃত্বের দুর্বলতা নিয়ে চিন্তার বহিঃপ্রকাশ—তা অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন।
বিএনপি বর্তমানে সাংগঠনিকভাবে এক চরম দুর্বল অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। একদিকে দেশের বাইরে অবস্থানরত শীর্ষ নেতার দীর্ঘ অনুপস্থিতি, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল পর্যায়ে সিদ্ধান্তহীনতা এবং মতবিরোধ, দলটিকে কার্যত একটি নিষ্ক্রিয় সংগঠনে পরিণত করেছে। সিনিয়র ও জুনিয়র নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য, নেতৃত্বে নতুনত্বের অভাব, তরুণদের যথাযথ অংশগ্রহণ না থাকা ইত্যাদি কারণে দলীয় কর্মীরা দিশাহীন হয়ে পড়েছে।
আসিফ আকবরের মন্তব্যে এই সংকটই স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি তাঁর বক্তব্যে ইঙ্গিত দেন যে, বিএনপির অনেক নেতার আচরণ আজ ক্ষমতাসীনদের মতোই আত্মপ্রশংসায় মোড়া এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এসব নেতৃবৃন্দ দলীয় আদর্শ নয়, বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিক আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়ে চলেছেন।
আসিফ আকবর বলেন, “যখন নেতারা দায়িত্বশীল না হয়ে অহংকারী হয়ে ওঠেন, তখন দলের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।” তার মতে, বর্তমান সময়ে বিএনপির যে অংশটি দম্ভিকতা ও একগুঁয়েমিতে নিমজ্জিত, তারা মূলত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন শাসনব্যবস্থার একটি প্রতিবিম্বে পরিণত হয়েছে। এরফলে, সাধারণ জনগণ বিএনপিকে আর বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে ভাবতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের আত্মঘাতী মনোভাব ও অহমিকা দলীয় কাঠামোর ভিত দুর্বল করে দেয়। নেতারা যখন নিজেদের ভুল বুঝতে চান না এবং গণমানুষের অনুভূতি বোঝার চেষ্টাও করেন না, তখন তারা কার্যত ক্ষমতার বাইরে থেকেও একনায়কতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করেন।”
আসিফ আকবর বারবারই বলে আসছেন যে, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন, বরং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশের ভবিষ্যৎ ও নেতৃত্ব নিয়ে ভাবনা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমি রাজনীতিবিদ না, তবে এই দেশের সন্তান হিসেবে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করাটা আমার দায়িত্ব। জনগণ এখন কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করে। তাই যারা নেতৃত্বের দাবি করছেন, তাদের আগে জনগণের চোখে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে হবে।”
রাজনীতিতে তরুণদের আগ্রহ, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা এখন একেবারে আলাদা। এক সময় যেসব দল তরুণদের উজ্জীবিত করত, এখন তারাই অনেকাংশে দুর্নীতিবাজ, পরিবারতন্ত্রে নিমজ্জিত এবং জনসম্পৃক্ততা হারিয়ে ফেলেছে। আসিফ আকবরের বক্তব্য এই প্রজন্মের সেই অসন্তোষের প্রতিধ্বনি বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা মনে করেন, আসিফ আকবর নিজে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে রাজনৈতিক বাস্তবতার একান্ত ভিতরের অনুভবকেই ভাষা দিয়েছেন। তরুণদের মধ্যে আজকে রাজনীতির প্রতি যে এক ধরনের বীতশ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে, তার মূল কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবিশ্বাসযোগ্যতা এবং দম্ভ।
আসিফ আকবরের মতো একজন সমাজসচেতন সংস্কৃতিজন যখন রাজনীতির ওপর এত খোলামেলা ও সাহসী বিশ্লেষণ করেন, তখন সেটিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এটি শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত বক্তব্য নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আত্মসমালোচনার দাবি।
তার মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের প্রতি একটি স্পষ্ট বার্তা উঠে এসেছে—“আপনারা যদি সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন চান, তাহলে আগে নিজেকে বদলাতে হবে। অহংকার নয়, প্রজ্ঞা ও সহমর্মিতা দিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে।”
আসিফ আকবরের বক্তব্য একটি সময়োপযোগী ও বাস্তবধর্মী রাজনৈতিক বিশ্লেষণ—যেখানে আমাদের রাজনীতির মূল ব্যাধি ‘দম্ভিকতা ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা’কে তুলে ধরা হয়েছে। নেতৃবৃন্দ যদি এসব সংকেত না বোঝেন, তাহলে শুধু বিএনপি নয়, গোটা দেশের গণতন্ত্রই আরেক দফা দুঃসময় দেখতে পারে।