শাহজাহান বাশার
চার দলীয় জোট সরকারের সময় থেকে শুরু হওয়া এই অবৈধ মাটি বাণিজ্য বিগত ১৬ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও চলেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে গোমতীর পাড়ের মানুষ আশার আলো দেখেছিল। ভেবেছিল, এবার বন্ধ হবে মাটি লুটের মহোৎসব। কিন্তু সে আশাও মাটিতে মিশে গেছে।
২০২৪ সালের আগস্ট মাসের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পেছনে এই অবৈধ মাটি কাটার ভূমিকা ছিল বড়। কুমিল্লার বুড়িচং, দেবিদ্বার, নাঙ্গলকোট, লাকসাম ও চৌদ্দগ্রামের বিস্তীর্ণ জনপদ ডুবে গিয়েছিল গোমতীর রুদ্ররোষে। স্থানীয়রা বলছেন, গোমতীর দুই পাড়ের মাটি কেটে নদীর চরকে যেভাবে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে, তাতে এমন বিপর্যয় একদিন হবেই, এটা জানা ছিল।
শীত আসতেই আবারও সক্রিয় হয়েছে মাটি খেকো চক্র। গোমতীর দুই পাড়ের প্রায় ৬৪ কিলোমিটারজুড়ে চলছে দখল-লুটপাটের উৎসব। দিন-রাত ট্রাক্টর আসা-যাওয়া করছে। নদীর ভেতর থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে, ফলে বাঁধের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। নদীর তীর ঘেঁষে যেসব রাস্তা ও সেতু রয়েছে, সেগুলোর পিচ উঠে গেছে, ফাটল ধরেছে, অনেক জায়গায় রাস্তা ধসে পড়ার উপক্রম।
স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তর—কেউই কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অভিযানের নামে হয় আলগা অভিযান, নয়তো লোক দেখানো জরিমানা। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গোমতীর তীর ঘেঁষা বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রভাবশালী মাটি খেকোদের দৌরাত্ম্য চরমে।
বুড়িচংয়ের কামারখাড়া: জসিম
আমতলী: আলমগীর
দুর্গাপুর: হোসেন মেম্বার, লিটন, মিজান, জুয়েল
দিঘীরপাড়: ইয়াকুব
এছাড়াও পাঁচথুবী ইউনিয়নের উত্তর রাছিয়া ও নিশ্চিন্তপুর এলাকায় ফসলি জমির মাটি কাটার অভিযোগও রয়েছে। রাতের আঁধারে ট্রাক্টর চালিয়ে চলছে মাটি পাচার।
একজন মাটি ব্যবসায়ী জানান, ৪০ শতক জমির মাটির দাম সাড়ে তিন লাখ টাকা। এই মাটি ট্রাক্টরে করে সরবরাহ করা হয় ইটভাটা ও কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন স্থানে। রাজনৈতিক দলের নেতারা ও প্রশাসনের কিছু লোক ‘ম্যানেজ’ করেই এই ব্যবসা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, দুর্গাপুর, ভাটপাড়া, চানপুর মাস্টারবাড়ি, পালপাড়া, বানাসুয়া, কাপ্তানবাজার এলাকাজুড়ে অবাধে মাটি কাটা চলছে। অনেক জায়গায় সড়ক কেটে ট্রাক্টর চলাচলের রাস্তা বানানো হয়েছে। চানপুর বেইলি সেতু ও বদরপুর রেলসেতুর পিলারের গোড়ায় মাটি কেটে নেওয়ায় সেতুগুলো মারাত্মক ঝুঁকির মুখে।
পুলিশ ফাঁড়ির সামনে দিয়েও চলে এই অবৈধ মাটি বাণিজ্য, কিন্তু কেউ বাধা দেয় না। বৈদ্যুতিক খুঁটি ও গাছের গোড়া থেকেও মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে, যা যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ইউএনও ফাতেমাতুজ জোহরা জানিয়েছেন, মাঝে মাঝেই অভিযান চালানো হয়, জরিমানাও করা হয়। তবে এই দায়সারা অভিযানে বড় কোনো প্রভাব পড়েনি।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোঃ আমিরুল কায়ছার বলেন, "জনগণকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। মাটি খেকোদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কঠোর অভিযান চালানো হবে।"
প্রশাসনের আশ্বাসের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা। নদীর দুই পাড়ের মানুষ বলছেন, "বছরের পর বছর ধরে শুধু শুনছি অভিযান হবে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি গোমতীর বুক খুঁড়ে মাটি নিয়ে যাচ্ছে মাটি খেকোরা। এটা কি চোখে পড়ে না?"
"গোমতী আমাদের বাঁচায়, আর এই গোমতীকে যারা মেরে ফেলছে, তাদের বিচার চাই। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এরা বেপরোয়া হয়ে গেছে। প্রশাসন আর কতদিন চোখ বন্ধ করে রাখবে?"
কুমিল্লার প্রাণ গোমতী আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে, ভবিষ্যতে এই নদী শুধু মানচিত্রেই থাকবে, বাস্তবে হারিয়ে যাবে।
এএনবি২৪ ডট নেট"একটি বহুল পঠিত অনলাইন বাংলা সংবাদপত্র,
প্রকাশক, মোহাম্মদ মাহামুদুল হাসান কালাম,
প্রগতি স্বরণী, ঢাকা-১২২৯
+৯৬০৭৩৩৯৬৯১
+৮৮০১৬৪৭০৫৩৪৪৯
বি: দ্র: প্রকাশিত সংবাদে কোন অভিযোগ
ও লেখা পাঠাতে আমাদের ই-মেইলে যোগাযোগ করুন। anbnewsbd@gmail.com
২০১২-২০২৫ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত – এএনবিটোয়েন্টিফোর ডট নেট