
মোঃ শাহজাহান বাশার,
স্টাফ রিপোর্টার,
সমাজ পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আচরণ, মূল্যবোধ এবং সম্পর্কের ধরনেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু বর্তমান সময়ে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার মতো মৌলিক মানবিক গুণগুলোর ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া। পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক শিষ্টাচার এবং পারস্পরিক সম্মানবোধ যেখানে একসময় শক্তিশালী ছিল, আজ সেগুলো অনেকাংশেই হারিয়ে যাচ্ছে।
এর পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করছে। ব্যক্তিস্বার্থপরতা, প্রযুক্তির বাড়াবাড়ি ব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, পারিবারিক শিক্ষার অভাব—এসবের প্রভাব স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। তরুণ প্রজন্ম ধীরে ধীরে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, অথচ ভার্চুয়াল জগতে তারা আসক্ত হয়ে পড়ছে। অভিভাবকদের প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা কমছে, শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে, সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
এই অবস্থার মধ্যে থেকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী শিখবে? ভবিষ্যৎ কি আরও বেশি স্বার্থপর, বিচ্ছিন্ন এবং আবেগহীন হয়ে উঠবে? নাকি আমরা এখনই সচেতন হয়ে এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারব?
নিউজ প্রতিবেদন: সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়—বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
ঢাকা, ২ মার্চ: দেশের সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোয় ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, বিগত এক দশকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ কমে আসছে, যা সমাজে বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, “সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো পারিবারিক শিক্ষার অভাব। শিশুদের যদি ছোটবেলা থেকেই মূল্যবোধ শেখানো না হয়, তাহলে তারা বড় হয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।”
মনোবিজ্ঞানী ড. নাহিদা সুলতানা মনে করেন, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারে মানুষ বাস্তব জীবনের সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতার মতো গুণগুলো ক্রমশ বিলীন হচ্ছে।”
অনেকেই মনে করেন, শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা, পারিবারিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করাই হতে পারে এই সমস্যার সমাধান।
সমাধান: কীভাবে ফিরিয়ে আনতে পারি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা?
১. পারিবারিক শিক্ষা: শিশুদের ছোটবেলা থেকেই শ্রদ্ধা ও সম্মানের শিক্ষা দিতে হবে। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা এবং নিজেদের আচরণের মাধ্যমে মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া।
- নৈতিক শিক্ষার প্রসার: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা, শিষ্টাচার ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
- প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার: ভার্চুয়াল সম্পর্কের চেয়ে বাস্তব জীবনের সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে মানসম্পন্ন সময় কাটানো উচিত।
- সামাজিক সচেতনতা: মিডিয়া, জনপ্রতিনিধি ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। নৈতিক মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে।
- মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব: শুধু পেশাগত বা ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, বরং মানবিক সম্পর্ককেও গুরুত্ব দিতে হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও ভালোবাসার চর্চা করতে হবে।
সমাজে যদি এই পরিবর্তনগুলো আনা যায়, তবে শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার অবক্ষয় ঠেকানো সম্ভব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদেরকেই একটি সুস্থ, সুন্দর এবং নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে হবে।