
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক বিভাগে আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসানোর দায়িত্ব যেন নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের প্রথম সচিব আমীমুল ইহসান ও দ্বিতীয় সচিব আহসান উল্লাহ। বদলি-পদোন্নতিতে এর প্রভাব পড়েছে।
শুল্ক ক্যাডারে আসা আওয়ামী লীগ পরিবার ও বিতর্কিত বিসিএস ক্যাডারদের জন্যও পদ সংরক্ষণের পাঁয়তারা করেছিল বর্তমান প্রশাসন। যদিও চাপের মুখে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। এবার বদলিতে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি সাইফুজ্জামান শেখরের ভাগিনা ও যুবলীগ নেতা রুপকের স্ত্রীকেও কাস্টম হাউসে পদায়ন করা হয়েছে। আওয়ামী পরিবারের সদস্য বিসিএস ৩১ ব্যাচের আরেক কর্মকর্তাকে আট মাসের মাথায় একটি কাস্টম হাউস থেকে তুলে আরও বড় কাস্টম হাউসে পদায়ন করা হয়েছে। আর নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে ফিডার পদ পূরণের পরও পান না পদোন্নতি। কৌশলে গ্রেডেশনভুক্ত করা হয় না নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এনবিআরের শুল্ক বিভাগের ক্যাডার ও নন-ক্যাডার বৈষম্য বেড়েই চলছে। দেশের অন্যান্য দপ্তরে নন-ক্যাডারদের ৫০ শতাংশ বরাদ্দ থাকলেও শুল্ক বিভাগে ৩০ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে। এসব পদে পদোন্নতি দিতেও নানা কৌশল অবলম্বন করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ফিডার পদ পূরণের পরও বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও গ্রেডেশন হয় না। এনবিআরের আয়কর বিভাগে যতটা দ্রুত গ্রেডেশন হয়, শুল্ক বিভাগের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে তা-ও হয় না। শুধু পদোন্নতি নয়, বদলির ক্ষেত্রেও হয় নানা ধরনের বৈষম্য। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা। এই আন্দোলনের ফলে এনবিআরের শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের দায়িত্ব পান শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এনবিআরের এক আদেশে শুল্ক ক্যাডারের দুই কর্মকর্তাকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর দায়িত্বে বসে তারাই বৈষম্য করছেন বলেও অভিযোগ নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের। হজের ছুটি পেতেও ঘুরতে হয় দিনের পর দিন। আর বদলির ক্ষেত্রে নিজস্ব বলয়ের বাইরে কর্মকর্তাদের পোস্টিং করা হয়েছে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। ক্যাডার সার্ভিসে থাকা কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে ঢাকার মধ্যে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আওয়ামী লীগ সরকারের যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতার স্ত্রীকেও পদায়ন করা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে।
বৈষম্যের বিষয়ে জানতে এনবিআরের শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের সদস্য ফারজানা আফরোজের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি উল্লেখ করে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। পরবর্তী সময়ে এনবিআরের প্রথম সচিব আমীমুল ইহসানকে কল করলে তিনি ফোন ধরেননি। গতকাল বুধবার খুদেবার্তা পাঠানোর পরও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব আহসান উল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ক্যাডার ও নন-ক্যাডারে কোনো বৈষম্য হচ্ছে না। আর ক্যাডার সার্ভিসে লোক কম হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে আরেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করা হয়েছে। যুবলীগ নেতার স্ত্রীকে কাস্টম হাউসে পদায়ন করার বিষয়ে তিনি জানেন না বলে কালবেলার কাছে দাবি করেন। এ ছাড়া তিনি শুধু সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছেন বলেও জানান।
সূত্র আরও জানায়, গতকাল বুধবার উপকমিশনার পদে বদলির আদেশ করেছে এনবিআর। এ আদেশে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের ডাটাবেজ টিমের সদস্য নাসিম আল মোমিন রুপকের স্ত্রীকে ঢাকার কম গুরুত্বপূর্ণ একটি দপ্তর থেকে কাস্টম হাউস আইসিডি কমলাপুরে বদলি করা হয়েছে। আরেক আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্যকে পানগাঁও কাস্টম হাউস থেকে আট মাসের মধ্যে বদলি করে ঢাকা কাস্টম হাউসে পদায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া তুমুল আলোচিত এইচ টি ইমাম বিসিএসখ্যাত ক্যাডারের তিন কর্মকর্তাকে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বদলি করা হয়েছে। যদিও এর আগে এই তিন কর্মকর্তার জন্য পদ শূন্য রেখে পদোন্নতির চেষ্টা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এনবিআরের শুল্ক ক্যাডারের চাপের মুখে এই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসে। এ ছাড়া কোটায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা করে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পদায়নের জন্য খসড়া তৈরি করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে এই প্রশাসনের বিরুদ্ধে। বর্তমান দ্বিতীয় সচিবও তার ভাই কোটায় ক্যাডার সার্ভিসে এসেছেন। এ ছাড়া শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের প্রথম সচিব আমীমুল ইহসান সাবেক চেয়ারম্যানের আমলে এনবিআরের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখায় পদস্থ ছিলেন। তৎকালীন চেয়ারম্যানের আমলেই বিদেশে যান এবং ফিরে এসে আরেকটি ভালো শাখায় যোগদান করেন। আর আন্দোলনের পর এ কর্মকর্তাকেই শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের প্রথম সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। যার কারণে সাবেক চেয়ারম্যানের আমলে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদস্থ কর্মকর্তাদের কাস্টম হাউস ও বন্ড কমিশনারেটে পদায়ন করছেন। সাবেক চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে তার সময়ে এনবিআরের এক প্রভাবশালী নারী কর্মকর্তাকে এনবিআর থেকে উত্তর বন্ড কমিশনারেটে পদায়ন করেছেন বলেও অভিযোগ করেছেন খোদ শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তারাই।