জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মালদ্বীপ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে কয়েক দশক ধরেই দেশটির অস্তিত্ব লোপের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম বিষয়টিকে আমরা বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করি। বিষয়টি অনুধাবনের পর আমাদের দেশে বড় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। জলবায়ু সংবেদনশীল ব্যবস্থার সমন্বয়ের দিকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে শুরু করা হয়। গোটা বিশ্ব আমাদের এই আবেদন কি শুনতে পেয়েছে? উত্তরটি প্রীতিকর নয়। ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় কাজ করে চলেছে। মালদ্বীপে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের শূন্য দশমিক ০০৩ শতাংশ হয়। তার পরও জলবায়ু সংকটের প্রথম অভিঘাত লাগে এই দেশটিতে। বিশ্বের ধনাঢ্য রাষ্ট্রগুলোর এক্ষেত্রে কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। তারপরও ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে অনুন্নত দেশগুলোর তুলনায় মাত্র ১৪ শতাংশ অর্থ দেওয়া হয়।
বিদ্যমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে নানা সমস্যা রয়েছে। বিশেষত মালদ্বীপের পক্ষে গ্রস ন্যাশনাল ইনকাম (জিএনআই) এবং গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়ানোই কঠিন হয়ে পড়ছে। মালদ্বীপের পর্যটন খাতের কারণে উন্নয়নশীল অর্থনীতি হিসেবে আমাদের আবির্ভাব ঘটেছে। পর্যটন খাতের বাইরে অন্যান্য খাতের অবস্থা ভালো না হওয়ায় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশও মালদ্বীপ। মালদ্বীপের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সঙ্গে কোনোভাবেই খাপ খাওয়াতে পারছে না। মালদ্বীপের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ৯৯ শতাংশ জল আর ১ শতাংশ ভূমি। ফলে বৈদেশিক অনুদানের অর্থকে কীভাবে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তার দিকনির্দেশনা জরুরি। না হলে অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়বে। সম্প্রতি তীব্র তাপমাত্রা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত ‘ফিলস লাইক’ তাপমাত্রাই দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে।
ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর প্রতি গোটা বিশ্বের দাতা সংস্থাগুলোর মনোযোগ বেশি নয়। যেন এই দ্বীপগুলো পর্যটনের জন্যই প্রাকৃতিকভাবে অবস্থিত। মালদ্বীপের রাজধানী মালের আয়তন নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের সমান। অথচ মালে জনসংখ্যাবহুল একটি শহর। এজন্য আমরা হুলহুমালে নামক কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করেছি। ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুই মিটার উচ্চতায় রয়েছে। জলবায়ু সংবেদনশীল অনেক বৈশিষ্ট্যও দ্বীপটিতে আরোপ করা হয়েছে। মালদ্বীপের উপকূলকে ভয়াবহ ঢেউ থেকে বাঁচাতে এমন একটি দ্বীপ প্রয়োজন ছিল। সম্প্রতি রাস মালে নামক আরেকটি প্রজেক্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারত মহাসাগরের প্রথম এই ইকো সিটিকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন মিটার ওপরে নির্মাণ করা হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে আমরা নানামুখী উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছি। কিন্তু এ ধরনের কাজ সফল করার ক্ষেত্রে প্রকৃতির সঙ্গে সংবেদনশীল প্রকৌশল ও নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনা অতীব জরুরি। সম্প্রতি আমাদের একাধিক প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে গেছে তীব্র দাবদাহে কোরাল ব্লিচিং নামক সমস্যা দেখা দেওয়ায়। রাস মালে মূলত প্রকৌশলগত সমস্যা। জলবায়ু অর্থায়নকারী সংস্থা এবং মাল্টিল্যাটারাল ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে নানাভাবে সহযোগিতা করছে। কিন্তু তাদের এই অর্থায়ন যে পুরোপুরি কাজে আসছে তা নয়। গোটা বিশ্বের এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার দাবি বহু দিনের। কিন্তু সেদিকে কারও এখনও মনোযোগ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে, ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো অর্থায়নের ওপর নির্ভর করে। অবকাঠামোগত সংকট আর জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় এই ধরনের অর্থায়ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জলবায়ু পরিবর্তনের জটিল সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক সহযোগিতা ও অনুদান আমাদের অনেক প্রয়োজন। কিছু প্রজেক্ট খণ্ড খণ্ড ভূমিকা সংযুক্ত করতে সাহায্য করে। আবার কিছু কিছু প্রজেক্ট নগরায়ণ, দেশের নাগরিকদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে।
সর্বোপরি দেশের অবকাঠামোকে জলবায়ু সংবেদনশীল করে তোলার মাধ্যমে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ গড়ে দেয়। নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনব্যবস্থা মালদ্বীপের জন্য একটি আশীর্বাদ হলেও বিশ্বসম্প্রদায়ের সহযোগিতা ব্যতিরেকে কোনোভাবেই তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। জাতিসংঘ ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সংঘ (সিডস)-এর চতুর্থ সম্মেলন আয়োজন করতে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র বড় সংকটে রয়েছে, সেসব দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টিডিমেনশনাল ভালনারেবিলিটি ইনডেক্স অনুসারে কেমন অবস্থায় রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হবে। এই পরিমাপের মাধ্যমে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর বর্তমান সমস্যা এবং জলবায়ুজনিত সংকট মোকাবিলার জন্য যে সম্পদ ঘাটতি রয়েছে, তা যাচাই করা যাবে। যদি এই সম্মেলনে এ বিষয়ে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়, তাহলে জলবায়ু সংবেদনশীল প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়টি নিয়ে নতুন ভাবনার সুযোগ উন্মোচিত হবে। বহুজাগতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক বা সার্বভৌম দাতা রাষ্ট্রগুলো নতুন একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে এবং এ নিয়ে ফলপ্রসূ কাজ করার সুযোগ অনেক বেড়ে যাবে। এখনও ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে বিশালসংখ্যক মানুষের বাস। তাদের প্রাণ ও সম্পদ ক্ষয়ের মুখে।
মে মাসের শেষদিকে এন্টিগুয়াতে সিডসের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ওই সম্মেলনে নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতেই হবে সবাইকে। গোটা বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের সিকিভাগও ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো থেকে ঘটে না। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় এই ধরনের রাষ্ট্রগুলোকে। যৌক্তিক কার্যকারণ দিয়ে কোনো দাবি আদায়ের পক্ষে এখন আলোচনা করার সুযোগ নেই। বরং গোটা বিশ্বকে বুঝতে হবে সমস্যা কতটা গভীরে প্রোথিত। জলবায়ু পরিবর্তন গোটা বিশ্বে যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছে এর অভিজ্ঞতার নিরিখে আমাদের অবস্থা যেন বিশ্বসম্প্রদায় অনুধাবন করতে পারেÑ এমন দাবিই করা হচ্ছে প্রতিবার। আমরা কোনো অনুদানের প্রত্যাশায় নই, বরং সম্পদের সুষম বণ্টন এবং বিদ্যমান জটিল সংকট মোকাবিলায় সুষ্ঠু ও সম্ভাবনাময় কোনো সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিই আমাদের বড় আহ্বান।
এএনবি২৪ ডট নেট"একটি বহুল পঠিত অনলাইন বাংলা সংবাদপত্র,
প্রকাশক, মোহাম্মদ মাহামুদুল হাসান কালাম,
প্রগতি স্বরণী, ঢাকা-১২২৯
+৯৬০৭৩৩৯৬৯১
+৮৮০১৬৪৭০৫৩৪৪৯
বি: দ্র: প্রকাশিত সংবাদে কোন অভিযোগ
ও লেখা পাঠাতে আমাদের ই-মেইলে যোগাযোগ করুন। anbnewsbd@gmail.com
২০১২-২০২৫ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত – এএনবিটোয়েন্টিফোর ডট নেট