
‘আমরা ডিম সিন্ডিকেট, ডাব সিন্ডিকেট শুনি, আমার কাছে মনে হয় ক্রিকেটের সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এটা চলছে, এভাবে চললে ক্রিকেটটা ধ্বংসের পথে যাবে,’ তামিম-সাকিব ইস্যুতে ফেসবুক লাইভে এসে এভাবেই ক্রিকেট বোর্ডের প্রতি নিজের ক্ষোভ জানিয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট।
বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আজ সেখানে প্রথম অনুশীলনের পর, শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) প্রস্তুতি ম্যাচ মাঠে নামবে বাংলাদেশ। কিন্তু সেসব নিয়ে আলোচনা-আগ্রহ কোনটাই নাই এখন ক্রিকেটভক্তদের।
বরং একদিন আগে বিশ্বকাপের দল ঘোষণা ও সেখানে তামিম ইকবালের না থাকাটাই জন্ম দেয় নানা বিতর্কের। এরপর সামাজিক মাধ্যমে এসে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন তামিম ইকবাল। আর রাতে এক সাক্ষাৎকারে তামিম ও নিজের প্রসঙ্গে নানা প্রশ্নের উত্তর দেন সাকিব আল হাসান।
তামিম তার ভিডিওতে সরাসরি সাকিবের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেননি, তবে সাকিব আল হাসান তার সাক্ষাৎকারে তামিম ইকবাল প্রসঙ্গে বেশ কয়েককটি মন্তব্য করেছেন।
যদিও তিনি দাবি করেছেন তামিমের বাদ পড়ার বিষয়ে তার কোনো ভূমিকা ছিলো না। সবমিলে ক্রিকেটের বাইরে এসব বিতর্কই এখন সামাজিক মাধ্যম থেকে চায়ের টেবিল সবখানে। যা স্পষ্টতই দুটো ভাগ গড়ে দিয়েছে সমর্থকদের মধ্যে।
ক্রিকেট প্রশিক্ষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেন, ‘আমরা সোশ্যালি এত ডিভাইড হয়ে যাই সহজে, এই ঘটনা আমাদের আরো ডিভাইড করে দিতে পারে। সামনে বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছি, এ সময় এই বিভক্তি আমাদের ফোকাসটা অন্যদিকে নিচ্ছে, যা বিশ্বকাপে নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করা নাজমুল আবেদীন ফাহিমও মনে করেন বিসিবি এই ঘটনা ঠিকভাবে সামলাতে পারেনি, ফলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে।
সাকিব-তামিম ইস্যু যেভাবে সামনে আসলো
বিশ্বকাপে দল ঘোষণার আগে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন ছিল দুটো?- তামিম ইকবাল কি থাকছেন, আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে কি দলে নেয়া হবে?
কিন্তু দল ঘোষণার পর সব আলোচনা ঘুরে যায় এক নম্বর প্রশ্ন ঘিরেই। তামিম ইকবালকে ছাড়াই ১৫ জনের বিশ্বকাপ স্কোয়াড ঘোষণা করে নির্বাচকরা। দল ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনেও সিংহভাগ প্রশ্ন ছিল এটা নিয়েই, তামিমকে কেন বাদ দেয়া হল?
নির্বাচকেরা এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলেন ফিটনেস ঘাটতি থাকার কারণেই তামিমকে দলে রাখা হয়নি। কিন্তু এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় অবশ্য দল ঘোষণার আগে থেকেই।
কয়েকটা গণমাধ্যমে খবর আসে তামিম বিশ্বকাপে ৫টা ম্যাচ খেলতে চেয়েছেন, আর সেটাই বড় কারণ তাকে বাদ দেয়ার। আবার এমনও বলা হয় বিশ্বকাপে তার ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন করতে চেয়েছে বোর্ড, যা তামিম মেনে নেননি, আর সে কারণেই বাদ পড়তে হয় তাকে।
আর এ সবগুলো ঘটনার পেছনে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে দায়ী করে একটা পক্ষ। তাদের দাবি, পুরোপুরি ফিট নয় এমন কোনো ক্রিকেটারকে অধিনায়ক সাকিব দলে চাননি বলেই তামিম ইকবালের জায়গা হল না বিশ্বকাপে। বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক।
আর এভাবেই গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের আলোচনায় এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তামিম ইকবাল আর সাকিব আল হাসান চলে আসেন মুখোমুখি অবস্থানে।
তবে এর পেছনে কোনো তৃতীয় পক্ষও কাজ করে থাকতে পারে বলে শঙ্কা সাকিব-তামিমের এক সময়ের কোচ নাজমুল আবেদীনের।
‘আমি খুব সম্প্রতি শুনেছি যে তারা কেউ কথা বলে না, আমি খুবই অবাক হয়েছি। কারণ তারা এত ক্লোজ ছিল যে পরিবারের চেয়ে বেশি সময় নিজেদের সাথে কাটিয়েছে। এটা নিশ্চয় মিনিমাইজ করা যেত, কেনো করা গেল না, আশে পাশে যারা থাকে তারা দূরত্বটা বাড়িয়ে দিলো কি না, কারণ অনেকে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পছন্দ করে।’
বিকেএসপির এই শিক্ষক মনে করেন সাকিব-তামিমের ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া মানে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভাগাভাগি, যা কাঙ্খিত নয়।
সাকিব-তামিম ইস্যু বিশ্বকাপে কতোটা প্রভাব ফেলবে
যে কোনো বড় টুর্নামেন্টের আগে প্রায়ই বাংলাদেশ দল শিরোনাম হয় মাঠের বাইরের ঘটনায়। তবে নাজমুল আবেদীন ফাহিম মনে করেন এবারেই সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটল।
‘শুধু ক্রিকেটের ক্ষতি হলো তাই না, আমাদের ইমেজটাও ক্ষতিগ্রস্ত হলো আন্তর্জাতিকভাবে। সবচেয়ে ভালো হত যদি এই পুরো বিষয়টা কনফিডেনশিয়াল থাকতো এবং সেভাবেই সমাধান হত।’
এক্ষেত্রে ক্রিকেট বোর্ডেরও দায় দেখেন তিনি। নাজমুল আবেদীন আরও বলেন, ‘ক্রিকেট বোর্ডের খুবই দুর্বল ভূমিকা ছিল। একটা জিনিস ঘনীভূত হচ্ছে, দলে কে থাকবে কে থাকবে না, এসব বিষয় নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষমতা বোর্ডের থাকা উচিত ছিল। একটা কৌশল থাকা উচিত ছিল। সেটা তো পারেইনি উল্টো সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল।’
অন্যদিকে এসব ঘটনায় রীতিমতো নিজের বিরক্তি প্রকাশ করেন সাবেক ক্রিকেটার খালেদ মাসুদ পাইলট।
তিনি মন্তব্য করেন, ‘নাটকের মতো সব ঘটনা। এভাবে টিম বিশ্বকাপ খেলতে যাবে? বাংলাদেশের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি একেবারে জঘন্য।’
তিনি সাকিব-তামিমের এই বিষয় কীভাবে এতদূর গেল, সামাজিক মাধ্যমে কেন আসলো নানান উড়ো খবর সেসবের তদন্ত করার আহবান জানান বিসিবির কাছে। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট বোর্ড সেটা করবে না। কারণ তাদের অনেকেই জড়িত। একজন দুজন আছে যারা ক্রিকেট বোর্ড ভাইরাসের মতো।’
এটা অন্য তরুণ ক্রিকেটারদের মনস্তত্বেও মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন নাজমুল আবেদীন। ‘বাকিরা এখন খুব সাবধানে পা ফেলবে। বুঝে গেল যে এই জগতটা আলাদা, এখানে মন খুলে কথা বলতে পারবে না, সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।’
এই ক্রিকেট কোচ মনে করেন এটা মোটেই কোনো দলের জন্য আদর্শ পরিবেশ নয়। কারণ পারস্পরিক নির্ভরতা আর বিশ্বস্ততা খুব জরুরী একটা দলের জন্য। আর বাংলাদেশ দলের এখন সেখানে ব্যাঘাত ঘটে গেল।
সূত্র : বিবিসি বাংলা