সরকারের বরাদ্দ থাকলেও এসব প্রকল্পের সুবিধা ঠিকভাবে পাচ্ছে না ছিন্নমূল শিশুরা। পথশিশু পুনর্বাসনে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার কোনো হিসাব নেই পুনর্বাসন কেন্দ্রের কারোর কাছে। মূলত জবাবদিহি ও তদারকির অভাবেই এ ধরনের কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে এ ধরনের উদ্যোগে অনিয়ম রোধ করা না গেলে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য অধরা থেকে যাবে।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়তে সরকারি বিভিন্ন দফতরের রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি নানা প্রকল্প। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরেই রয়েছে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র। পথশিশুদের অভিযোগ, সেখানে গেলে ঢুকতে দেওয়া হয় না তাদের।
তার প্রমাণ মিলল মাঠ পরিদর্শন করতে আসা এক কর্মীর সঙ্গে পথশিশুদের বাকবিতণ্ডা দেখেই।আশ্রয় কেন্দ্র দুটিতে নিত্যদিনের খরচ দেখতে চাইলে কোনো কাগজই দেখাতে পারেননি তারা।
অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, শিশুদের পুনর্বাসনে বিভিন্ন খরচে হচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতি।প্রতিদিন শিশুদের দুপুরের খাবার খরচ বাবদ সরকারি বরাদ্দ ১৩০ টাকা। তবে কত টাকা খরচ করা হয় সেই হিসাব জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রমের পরিচালক ডা. আবুল হোসেন পুনর্বাসন কেন্দ্রের গত তিন বছরের কোনো হিসাবের ফাইল বা কাগজের হিসেব নেই। তিনি জানান, ‘এত হিসাব তার পক্ষে রাখা সম্ভব নয়’। আর হাতে কলমে যে হিসাব তিনি তাৎক্ষণিক দিয়েছেন, তার সঙ্গেও মিল নেই বাস্তবের। তিনি বলছেন, ৫ মাসের বাড়ি ভাড়া, প্রোগ্রাম বাবদ খরচ ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
এ হিসাবের খোঁজে সরকারি হিসাব ভবনে যায় সময় সংবাদ। সেখানেও মেলেনি হিসাব সংক্রান্ত কোন তথ্য। তারা বলছেন, সব নথি প্রোগ্রাম পরিচালকের কাছে। এসব বিষয়ে বারবার যোগযোগ করা হলেও ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা।
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ডা. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবেই এসব কার্যক্রমের অর্থ পৌঁছাচ্ছে না সুবিধাবঞ্চিতদের কাছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে সরকারি দুর্নীতি প্রতিরোধের পরামর্শ তার।
তিনি বলেন, সবকিছুর মধ্যেই এখানে অনিয়ম এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এবং সেটির সুযোগটা যারা এর সাথে জড়িত তারা করে নিয়েছেন। যেহেতু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পরীবিক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি সেহেতু এটা চলছে এভাবেই। আমি মনে করি এখানে এক ধরনের যোগসাজশ চলছে। যারা করছে এসব তাদের সাথে সহায়ক অনেক শক্তি রয়েছে। তারা এর থেকে সুবিধাটা পাচ্ছে।
কাজেই তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সরকারের বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন ও দেখভালের অভাবে এসব শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ ও শিশুশ্রমে; যা সমাজের জন্য অশনিসংকেত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন,
পথশিশুরা পথে থাকলে আমরা তিনটা এসডিজি সরাসরি ফেল করব। সরকারের ভিশন পূরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং ১০ বছর পর এই শিশুরাই দেশের বোঝা হবে, তারা বিভিন্ন সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা আর সেটাই যদি আমরা না পারি তাহলে অর্থনৈতিকভাবেও আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হব।
‘কত রাত যে পানি খাইয়া ঘুমাইছি তার হিসাব নাই
রাজধানীর সদরঘাটের ফুটপাতই আল আমিনের ঘর। বাবা-মা কে তা জানে না সে। শুধু জানে তার বাড়ি ভোলা জেলায়। ছোটবেলা থেকেই সদরঘাটে বেড়ে ওঠা।
বয়স আনুমানিক ১৫। প্রতিদিন ভাত জোটানোই যেন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আল আমিন বলে, কতো রাইত, দিন যে পানি খাইয়া ঘুমাইছি তার হিসাব নাই।
সোমবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে দেখা গেলো আল আমিন ময়লা থেকে প্লাস্টিক, বোতল তুলছে। এসব সে বিক্রি করবে। দিনে তার আয় ১০০ থেকে ১২০ টাকা। ভোরবেলা বস্তার ওপর ঘুমায়।
আল আমিন বলে, ভাত রাইন্দা খাইলে খরচ কম হতো। কিন্তু কোন বুদ্ধি নাই রান্দোনের। দুপুরে আর রাইতে ভাত খাইতেই সব ট্যাকা শ্যাষ হইয়া যায়। আমার বাপ মায়ের চেহারা মনে নাই। খালি মনে আছে বাপের লগে লঞ্চে কইরা সদরঘাটে আইচিলাম। আর কিচ্চু মনে নাই। খালি নামটাই। এক চাচায় প্রথম দিকে কাছে কাছে রাখতো। হেই চাচার লগে একদিন ঘুমাই। সকালে উইট্টা দেখি চাচাও সাথে নাই। পরে তারে আর পাই নাই।
আল আমিন একা নয়। তারা পাঁচ থেকে সাতজন এক সাথে থাকে। সারারাত প্লাস্টিক কুড়ায়। তাদের কারো সাথেই বাবা-মায়ের যোগাযোগ নাই। আল আমিনের এরাই সব। জানতে চাইলে আল আমিন বলে, করোনার সময়ের কথা। রাইতের লঞ্চে এক যাত্রীর কাছে খাবার চাইছিলাম। সারাদিন আছিলাম না খায়া। তবুও খাবার দেয় নাই। খিদার জ্বালায় হাত থাইক্যা কাইড়া নিয়া দৌড় দেই। ব্যাটারা আমারে এমন মাইর দিছে মুখ দিয়া রক্ত বাইর হইছে। তারপর তারা কয়, আমি নাকি মানিব্যাগ নিয়া দৌড় দিছি। আমার সারা শরীর খুইজাও মানিব্যাগ পায় নাই। সদরঘাটের গার্ডরা মানিব্যাগের লাইগা বাইন্দা পিটাইছে। আমি দিমু কই থাইক্যা, আমিতো খালি খাবারের একটা পলিথিন লইয়া দৌড় দেই। মানুষ পশুপাখিরেও খাওন দেয় আমগোরে দেয় না।
কমলাপুর রেলস্টেশনে, তারেক তার বাবা মারা যাওয়ার পর আট বছর বয়সী তারেকের দিন কাটে পথে পথে। চেষ্টা একটাই, বেঁচে থাকার জন্য দু’বেলা খাবার জোগাড় করা। গরম কাপড়ের চাহিদা তার জন্য নিছক বিলাসিতা। কমলাপুরের এই প্ল্যাটফর্মে এমন অনেক শিশু খুঁজে পাওয়া যাবে, যাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত কাটে চরম দুর্দশায়।
২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। এরপর নতুন করে কোনো গবেষণা না থাকলেও মহামারিতে এর সংখ্যা আরও বাড়ছে বলে আশঙ্কা গবেষকদের।
প্রতি বছরই এসব শিশুদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনে সুস্থ সুন্দর জীবনের লক্ষ্যে সরকারের বাজেটে থাকে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প। তবে এসব প্রকল্পে কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে তা বোঝা যায় পথে এসব শিশুদের চিত্র দেখেই।
এএনবি২৪ ডট নেট"একটি বহুল পঠিত অনলাইন বাংলা সংবাদপত্র,
প্রকাশক, মোহাম্মদ মাহামুদুল হাসান কালাম,
প্রগতি স্বরণী, ঢাকা-১২২৯
+৯৬০৭৩৩৯৬৯১
+৮৮০১৬৪৭০৫৩৪৪৯
বি: দ্র: প্রকাশিত সংবাদে কোন অভিযোগ
ও লেখা পাঠাতে আমাদের ই-মেইলে যোগাযোগ করুন। anbnewsbd@gmail.com
২০১২-২০২৫ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত – এএনবিটোয়েন্টিফোর ডট নেট