বাংলাদেশে মেধা যাচাইয়ের সহজ উপায় হলো- ভুল হলেও অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পারা। এসএসসি, এইচএসসিতে গোল্ডেন এ+ পাওয়া। কোচিং সেন্টারে দিনকে রাত করে (উন্মাদ হয়ে) নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া। অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া। বিসিএস গাইড বই তোতাপাখির মতো মুখস্থ করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্যাডার সার্ভিসে চাকরি করা। পেশা হিসাবে নামের সাথে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও ব্যারিস্টার ইত্যাদি থাকা; পিএইচডি থাকলে তো কথাই নেই! আপনি এই ক্যাটাগরির বাইরে হলে আর যাই হোক সমাজের চোখে মেধাবী নয়। অতি সাধারন শিক্ষিত একজন কমদামী পাবলিক মাত্র।
মেধা ও প্রতিভা কী এক জিনিস?
মেধা হলো একজন মানুষের বিশেষ কিছু গুনাবলী ও দক্ষতা; অপরদিকে প্রতিভা হলো একজন মানুষের সৃজনশীল মানসিকতা ও অনেক দূরুহ কোন কাজে হাত দেওয়া বা আবিষ্কার করা; যা আগে কেউ করেনি, অথবা করলেও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। তবে মেধা ও প্রতিভার মধ্যে সুক্ষ কিছু পার্থক্য থাকলেও এ দু’টির সমন্বয়ে মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটে, নতুন নতুন আবিষ্কারের পথ সুগম হয় এবং অর্জিত শিক্ষা থেকে মানুষের উপলব্ধি হয়।
জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি তা উপলব্ধি করাটাও জরুরী; যেমন, প্রতিভা ও মেধার পাশাপাশি তার বিকাশ করাটা জরুরী। জ্ঞানীরা চিন্তাশীল ও যুক্তিনির্ভর হয় বলে অন্যের যুক্তিপূর্ণ মতামতকে মর্যদা দেয়, আর যুক্তির মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগায়; একাডেমিক শিক্ষায় অর্জিত সার্টিফিকেট; পিএইচডি ডিগ্রি এগুলো একাডেমিক স্বীকৃতি মাত্র। এগুলো অর্জনের পাশাপাশি মেধা, প্রতিভা, বোধশক্তি, চিন্তাশক্তি, আচরণ, সততা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলার সমন্বয় ঘটাতে হয়।
মানুষ যত জ্ঞানী হয় ততো ধীর হয়; বিনয়ী হয়; মনোযোগী হয়; ভাবুক হয়; যুক্তি নির্ভর হয়; মানবিক হয়; বিবেকবান হয়; স্বল্পভাষী হয়। একাডেমিক জ্ঞান অর্জন করে এটমিক বোমা তৈরী করে কয়েক লক্ষ মানুষকে মেরে ফেললে তাকে জ্ঞানী বলা যাবে না; তিনি জ্ঞান পাপী। কারণ, মেধা ও প্রতিভার সাথে তার বিবেক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার শিক্ষা অর্জিত হয় নাই। একজন মেধাবীর আত্ম উপলবদ্ধির স্তর যত উপরে উঠবে তার জ্ঞানের পরিধি ততো বাড়বে।
তবে, জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি মানুষের অহঙ্কার বোধটিও বাড়তে থাকে; এটি মানুষের সহজাত ব্যধি। এ ব্যধিকে সতর্কতার সাথে দূরে সরিয়ে এগিয়ে যেতে হয়; না হলে এই রোগটি জ্ঞানীকে জ্ঞান পাপী বানিয়ে ছাড়বে। যিনি একে দমিয়ে রাখতে পারেন তিনিই সফল হন।
শিক্ষা এবং প্রকৃত শিক্ষার মধ্যে যেমন পার্থক্য আছে; ঠিক তেমনি মেধাবী ও প্রকৃত মেধাবী শব্দের মধ্যেও গুণগত পার্থক্য আছে। এ পার্থক্য আমরা অনেকেই বুঝি না, আবার বুঝলেও মেনে নেই না।
আমরা বুঝে অথবা না বুঝে বাচ্চাদেরকে শিশুকাল থেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ঠেলে দেই। বাসা-বাড়িতে বাচ্চাদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলি! যারা ছোট বয়স থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ার সুযোগ পাইনি তারা বড় হয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করি। এসব পড়াশুনার উদ্দেশ্য যতটুকু না জ্ঞান অর্জন করা তার চেয়ে অনেক বেশি অগ্রাধিকার থাকে ভাল করে ইংরেজি বলতে পারা। দেশে ভাল চাকরি পেতে ভাল ইংরেজি জানাদের কদর কম ইংরেজি জানাদের চেয়ে বহুগুনে বেশি।
যদিও বেশিরভাগ কাজে ইংরেজি জানাটা আবশ্যিক নয়।
সম্প্রতি টিভিতে একটি বিজ্ঞাপনে দেখলাম, এক শিল্পপতি তার কারখানার জন্য একটি স্থান পছন্দ করতে গেছেন; স্থানটি তার শিল্প প্রতিষ্ঠান করার উপযোগী। কিন্তু তারপরও তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছেন, কারণ এখানে তিনি স্মার্ট ম্যানেজার পাবেন না এই ভেবে। তখন বিজ্ঞাপনটিতে দেখা যায়, হঠাৎ সুন্দর পোশাক পরা এক নারীর ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে বলতে উপস্থিতি। ব্যাস, শিল্পপতির চিন্তা দূর হয়ে গেল, তিনি স্মার্ট এবং শিক্ষিতা ম্যানেজার পেয়ে গেলেন!
দুই-একটি শব্দ ইংরেজিতে বলতে পারাটা কি স্মার্ট বা শিক্ষিতের পরিচয় বহন করে?
……….মেধাবীও!
শুধুমাত্র একটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করার ভাবনা থেকে পড়াশুনা করলে তা কোন অবস্থাতে প্রকৃত শিক্ষা বলা যাবে না। আর যা প্রকৃত শিক্ষা নয়, তা দিয়ে মেধার বিকাশ ঘটে না। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন করা, ভাষা শিক্ষা নয়।
শিক্ষা মানসম্মত কিনা তা ভিন্ন বিষয়, তবে শিক্ষার মান যাচাইয়ে ইংরেজি ভাষা জানাটা একমাত্র সুচক হতে পারে না। বাংলায় লিখে যদি উদ্দেশ্যটা পূরণ হয়, তাহলে তা ইংরেজিতে লিখতে হবে কেন? আমি ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতা করছি না। দেশের শিক্ষার মান উন্নয়নে ইংরেজি ভাষা শেখার প্রয়োজন আছে, তবে এটা ঠিক না ইংরেজি ভাষা না জানলে শিক্ষিত না। আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষা স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হলো ইংরেজি ভাষা। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে উচ্চ স্তরের শিক্ষাটা এদেশের শিক্ষার্থীরা কতটুকু হৃদয়াঙ্গম করতে পারছে তা দেখার বিষয়।
……….ভাবনার বিষয়!
এখন কিন্ডার গার্ডেন স্কুল বাংলাদেশের অন্যতম সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যেখান থাকার কথা ছিল সরকারের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ সেখানে হচ্ছে ব্যবসা। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে এমন নির্লজ্জ ব্যবসা নেই। সেবা খাতগুলো যখন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন তা লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। শিক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসা ও গণ পরিবহন তার নিষ্টুর উদাহরণ।
প্রাইমারি লেভেলের একটি বাচ্চাকে চৌদ্দ পনেরটি বই নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হয়। তার সাথে খাতা-কলমসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র তো আছেই। এজন্য অনেক সময় বইয়ের ব্যাগ বহন করার জন্য বাবা-মা অথবা অন্য কেউ বাচ্চাটির সাথে যেতে হয়। অথচ শিশু শিক্ষা হওয়ার কথা ছিল আনন্দের। সে হেসে খেলে পড়াশুনা করবে, যাতে তার মনে শিক্ষাভীতি না আসে। ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে দেখেছি শিশুরা বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায় না, তার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো স্কুলে থাকে। তার পড়াশুনার পাঠ স্কুলেই শুরু, স্কুলেই শেষ। নেই হোমওয়ার্কের বাড়তি ঝামেলা। এজন্য মনের আনন্দে শিশুরা স্কুলে যায়।
আর আমাদের দেশে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। যত দামী স্কুল তত বেশী বই-খাতা ও হোমওয়ার্ক। এটা কেমন শিক্ষা ব্যাবস্থা? একটি বাচ্চার ওজনের চেয়ে বইয়ের ব্যাগের ওজন বেশি হবে কেন? তাহলে শিক্ষা কি শিশুদের জন্য বোঝা? যে বয়সে আনন্দের সাথে বাচ্চারা শিক্ষা অর্জন কারার কথা সে বয়সে আমরা শিশুদের মনে শিক্ষা ভীতি তৈরি করছি। শিক্ষা কী? তা বুঝে উঠার আগেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার পর পরীক্ষা নিচ্ছি, তোতা পাখির মত মুখস্থ করাচ্ছি, ভয় দেখিয়ে দিচ্ছি। আর উপরি উপদ্রব হিসেবে আছে বিভিন্ন সিস্টেমের গৃহশিক্ষকের ব্যাবস্থা।
সেকেন্ডারী শিক্ষা ব্যাবস্থা তো আরো ভয়াবহ। প্রতিদিন স্কুলগুলোতে ৬-৮ টি বিষয়ে পাঠদান করা হয়, গড়ে একেকটি বিষয় ৩০-৩৫ মিনিট করে পড়ানো হয়, এতে করে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। মফস্বলের কোন কোন ক্লাসে তো ২০০-২৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকে। একজন শিক্ষকের দ্বারা ইচ্ছা থাকলেও এত অল্প সময়ে বিপুল শিক্ষার্থীদের কোয়ালিটি সম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। আছে শিক্ষক স্বল্পতা ও ছাত্র-ছাত্রীদের অপর্যাপ্ত বসার আসন । এছাড়া আছে কম দক্ষতাসম্পন্ন ও ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের ছড়াছড়ি।
কিছু অসাধু শিক্ষক বাসায় প্রাইভেট পড়ানোর জন্য শ্রেণীকক্ষে ঠিকমতো পাঠদান করে না। একটি ছাত্র যদি স্কুলে পড়ার পরও একই শিক্ষকের বাসায় সারা বছর প্রাইভেট পড়তে হয় তাহলে স্কুলের প্রয়োজন কেন? এমনও শোনা যায় স্কুলের শিক্ষকের বাসায় না পড়লে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা যায় না। আবার কোন কোন বেসরকারী স্কুল শিক্ষকদের এতো অল্প বেতন দেয়, তা শিক্ষকদের স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে শেষ হয়ে যায়। এজন্য অনেক সময় বাধ্য হয়ে তারা প্রাইভেট কোচিং করান।
ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত এত বিষয় পাঠ দান করা হয় সত্যি তা ভীতিকর। নবম শ্রেণীতে উঠলে তো আবার বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য কত যে শাখা প্রশাখা। আমাদের দেশের মুখস্ত নির্ভর শিক্ষা ব্যাবস্থা, যা আমাদের শিক্ষার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিচ্ছে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যেখানে হওয়ার কথা ছিল জ্ঞান অর্জন করা, গবেষনা করা, মূল্যবোধ সৃষ্টি করা; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা আজ পরীক্ষা ও চাকরি নির্ভর। যে দেশে লক্ষাধিক ছেলে মেয়ে এস এস সি পরীক্ষায় A+ পায়, সে দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা শুধু গলদপূর্ণই নয়, জাতির মেধা বিকাশের অন্তরায়ও বটে।
ছেলে মেয়েরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যদি স্কুলের পাঠ্যবই নিয়ে স্কুল আর শিক্ষকদের বাসায় বাসায় দৌড়ায় তাহলে তার সৃজনশীল মন মানষিকতা সৃষ্টি হবে কখন? সবাইকে বুঝতে হবে মানুষের জন্ম হয়নি শুধু পড়াশুনা করা জন্য। সরকার ও অভিবাবকদের দায়িত্ব ছাত্র/ছাত্রীদের প্রয়োজনীয় বিনোদন ও খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা; তাদের শারিরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য যা অত্যাবশ্যক। সৃজনশীল মননের জন্য প্রয়োজন স্বাধীনভাবে চিন্তা শক্তিকে বিকশিত করার পর্যাপ্ত সময় ও পরিবেশ। কিন্তু পাগলাটে এ শিক্ষা ব্যবস্থা ছাত্র ছাত্রীদের সৃজনশীল ও স্বাধীন সত্তাকে বিকশিত হতে দিচ্ছে না। ছাত্র ছাত্রীদের পাশাপাশি বাবা মায়েরা সারা বছর ব্যস্থ থাকেন সন্তানদের পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের নেশায়। যত টাকা লাগুক এ+ যে পেতেই হবে।
এক সময় দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে নকলের মহাউৎসব চলতো; এখন নকল অনেকটা বন্ধ হলেও শুরু হয়েছে নতুন উপদ্রব! ডিজিটাল সিস্টেমে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা; অনেকটা ঘোষণা দিয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চলে চড়া দামে প্রশ্ন বেঁচা কেনা! এ প্রশ্নের ক্রেতা কিন্তু ছাত্র/ছাত্রীরা নয়; সন্তানের গোল্ডেন পেলাসের ফ্যন্টাসিতে ভোগতে থাকা বাবা-মায়েরা। এমনও শুনা যায় পরীক্ষার পর বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারির যোগসাজোশে বড় অঙ্কের সেলামির বিনিময়ে পেলাসের (+) সুব্যবস্তা করা যায়; অভিযোগ আছে এতে কোন কোন স্কুল/কলেজের হেড মাস্টার/অধ্যক্ষ জড়িত!!
আর সৃজনশীলতার নামে আমাদের দেশে যা হচ্ছে তা প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। এই শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষাও নয়, আবার সৃজননশীলও নয়। আর কোচিং বাণিজ্য নিয়ে কী আর লেখবো। শিক্ষাকে ক্লাসরুমে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ, যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যাবস্থার প্রচলন, প্রয়োজনীয় কিন্তু ছোট আকারের সিলেবাস তৈরী করা, চাকরি ও রিজাল্ট নির্ভর মেন্টালিটি পরিহার করে জ্ঞান নির্ভর ও গবেষনাধর্মী শিক্ষা ব্যাবস্থা শুরু করা। সর্বাপরি অভিবাবকদের সচেতন হওয়া, যাতে বাচ্চাদের প্রকৃত শিক্ষা অর্জন বাদ দিয়ে কত ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে এবং কতজন শিক্ষক/কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে তা মুখ্য না হয়।
আপনি কী চান তা বাচ্চার উপর চাপিয়ে না দিয়ে, বরং সে কী চায়, কোন বিষয়টি তার পছন্দ বোঝার চেষ্টা করুন। বাসায় বাচ্চাদে সাথে নিজের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা উচিৎ, এতে সম্পর্ক আর গাঢ় হবে। স্কুলে যাতে শুদ্ধ করে বাংলা শিখতে ও বলতে পারে সেজন্য শুরু থেকে শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বর্ণমালা শেখানোর চেষ্টা করা প্রয়োজন। খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিন, তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, সময় পেলে বাচ্চাদের নিয়ে তাদের পছন্দের জায়গায় ঘুরে আসুন। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং কৃষ্টি-কালচার নিয়ে আলোচনা করুন।
যাদের ছেলে মেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করে, খেয়াল রাখবেন যাতে শুদ্ধ করে বাংলা লেখতে, পড়তে ও কথা বলতে পারে। পৃথিবীর কোন সভ্য সমাজ নিজের মাতৃভাষা বাদ দিয়ে বিজাতীয় ভাষা চর্চা করে না। এজন্য সন্তান ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করে বলে বাংলার ব্যাপারে উদাসীন হলে চলবে না। শুধু ইংরজি কেন? সম্ভব হলে জাপানিজ, চায়নিজ, রাশিয়ান, কোরিয়ান, জার্মান, স্পেনিশ, পর্তুগিজ, ফ্রেঞ্চ ও ডাচ ইত্যাদি ভাষা চর্চায় উৎসাহ দিতে পারেন।
প্রতি বছর বাংলাদেশে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে গোল্ডেন এ+ ও এ+ পায়। তাহলে কী বলবো বাকিদের চেয়ে এরা অনেক বেশী মেধাবী?
……….জানে ও বুঝে?
না, আমি তা মনে করি না। যে ছেলেটি শুধুমাত্র গোল্ডেন এ+ পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট একটি সিলেবাস দিনের পর দিন মুখস্ত করে গেল শুধুমাত্র পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের আশায় তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান থাকে ভাল রেজাল্ট, ভাল শিক্ষা অর্জন করা নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য নয় দিনের পর দিন শুধু নির্দিষ্ট সিলেবাস তোতাপাখির মতো মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় লেখা। প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো যা পড়েছে তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা, নিজের মত করে জানা। এতে ছাত্রদের স্বাধীন সত্তার বিকাশ ঘটে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য ছাত্ররা এ+ এর চিপায় পড়ে ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত শুধু একাডেমিক বই নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তারা এত প্রেসারে থাকে যে, অন্য বিষয় নিয়ে ভাবনার সময়টা পর্যন্ত পায় না।
আমি মনে করি যে ছেলে-মেয়েটি কোনদিন কোন প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে যায়নি, এক্সক্লুসিভ সিলেবাস পড়েনি। একাডেমিক বই পড়াকে ধ্যানজ্ঞান না করে অপাঠ্য বই পড়ে, সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত রাখে, ডিবেট করে, গল্প/কবিতা লেখে ও পড়ে, খেলাধূলা করে, টিভিতে পছন্দের টিমের খেলা মন ভরে উপভোগ করে সে পরীক্ষায় ‘বি-গ্রেড’ পেলেও প্রকৃত মেধাবী।
পরীক্ষায় এ+ পাওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে তাদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করা। জানার আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া। শেখার জন্য কৌতুহলী হওয়া। উন্নত দেশগুলোতে এভাবেই ছাত্র ছাত্রীদের মোটিভেট করা হয়। তারা পড়ালেখার জন্য ছাত্রদের উপর কোন চাপ প্রয়োগ করে না। ফলে ছেলেমেয়েরা আনন্দের সাথে শিক্ষা নেয়, জ্ঞান অর্জন করে। সিলেবাসের বাইরে গিয়ে নতুন নতুন জিনিস জানার চেষ্টা করে। তাদের সিলেবাসটাও আমাদের চেয়ে অনেক ছোট।
চাপিয়ে দিয়ে জোর করে হয়তো এ+ পাওয়ানো যায়। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে হয় আনন্দের সাথে নিজের ইচ্ছায়। চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা ছেলেমেয়েদের ক্রিয়েটিভ আইডিয়াগুলো নষ্ট করে দেয়। এজন্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি পড়াশুনা করলেও তাদের মতো গবেষক, সাইন্টিস্ট আর দার্শনিক হতে পারেনা। তারা রেজাল্ট দেখেনা, দেখে ক্রিয়েটিভিটি। আমরা বাচ্চাদের ক্রিয়েটিভ মাইন্ডকে ধ্বংস করে প্রাধান্য দেই ভাল রেজাল্ট আর ভাল চাকরিকে।
একটি ধাঁধা দেই; বলুন তো পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা প্রাইমারী ও সেকেন্ডারি শিক্ষা ব্যবস্থা কোন দেশে আছে? ভাবুন, ভাবতে থাকুন! এবার মনের মধ্যে ২-৩ টি দেশের নাম উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে; তাই না? তবে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবো আপনি যে দেশগুলোর কথা এই মুহুর্তে ভেবেছেন সে দেশগুলোর তালিকায় নিশ্চয়ই ফিনল্যান্ডের নাম নেই। হ্যা, স্কেন্ডিনেভিয়ান এ দেশটি গত বেশ কয়েক বছর থেকে তালিকায় শীর্ষে। গবেষণায় দেখা গেছে এই সফলতার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো দেশটির গ্রাম/শহর ভেদাভেদ না রেখে প্রতিটি স্কুলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া; দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকা দিয়ে পাঠদান করা; এছাড়া তাদের শ্রেণীকক্ষে সকল ছাত্রকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফিনিশ স্কুলগুলোতে খুব সামান্য হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়; মূলত শ্রেণীকক্ষেই শিক্ষকরা পাঠদান শেষ করেন। এছাড়া পরীক্ষার কোন কড়াকড়ি নেই; শুধু ১৬ বছর বয়সের সময় বাধ্যতামূলক পরীক্ষা (জিসিএসই) নেওয়া হয়।
তালিকায় এর পরেই আছে যথাক্রমে, (২) সুইজারল্যান্ড; (৩) বেলজিয়াম; (৪) সিঙ্গাপুর; (৫) নেদারল্যান্ড; (৬) কাতার; (৭) আয়ারল্যান্ড; (৮) এস্তনিয়া; (৯) নিউজিল্যান্ড; (১০) জাপান। (The Independent, UK)
তবে উচ্চশিক্ষায় (বিশ্ববিদ্যালয়) যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পৃথিবীর অন্য যেকোন দেশের ইউনিভার্সিটির চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে। এরপর আছে যথাক্রমে, (৩) জার্মানী; (৪) অস্ট্রেলিয়া; (৫) কানাডা; (৬) ফ্রান্স; (৭) নেদারল্যান্ড; (৮) চায়না; (৯) দক্ষিণ কোরিয়া; এবং (১০) জাপান। এই তালিকাটি চারটি মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে; (ক) শিক্ষার গুনগত মান ও পদ্ধতি অর্থাৎ পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষা ও গবেষণায় গুণগত তুলনা; (খ) পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিতি; (গ) দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়া বা তালিকাভুক্ত হওয়া; (ঘ) দেশটির গড় মাথাপিছু আয়। (QS.uni.cou.Rnk)
আমরা গরু দেখে দেখে বড় হয়েছি তারপরও গাইড বই পড়ে গরুর রচনা মুখস্ত করি। একটা ছাত্রকে যদি বলা হত তুমি যেভাবে গরু দেখেছ সেভাবে গরুর বর্ণনা কর তাহলে তার মধ্যে চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটত। গরু নিয়ে ভাবত। অন্যের লেখা গরুর বর্ণনা কষ্ট করে মুখস্ত করতে হত না। আর এটাই ছাত্রদের থিংকার বানায়, গবেষক হওয়ার পথ প্রসারিত করে। এজন্য নোট বইয়ের বিরূদ্ধে আমার কঠোর অবস্থান। অন্যের লেখা পড়ে ভাবটা নিজের মধ্যে ধারণ করা যায় না। এজন্য গাইড বই মুখস্ত করতে হয়। মুখস্ত করা শিক্ষা হচ্ছে তলা বিহীন ঝুড়ি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়াটি আরো পাগলাটে। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েই ছেলমেয়েরা ভর্তি যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার জন্য শুরু করে কোচিং সেন্টারগুলোতে দৌড়-ঝাঁপ। আমি এমনও ছাত্র দেখেছি এইচএসসি পরীক্ষা যেদিন শেষ হয়েছে সেদিন সারা রাত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি গাইড পড়েছে! এটা কী ছাত্রদের অসুস্থ মানসিকতার লক্ষণ নয়? আর অসুস্থ মানসিকতা আসে অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্য। যার ফলে তার মধ্যে এক ধরণের অস্তিরতা বিরাজ করে। বাধ্য হয়ে পাঠ্য বই-গাইড আবার পড়ে। এতে আর যাই হোক মেধার বিকাশ হয় না।
অথচ এ সময়টাতে ছেলেমেয়েরা আনন্দ ফুর্তি করার কথা, পাঠ্য বই থেকে দূরে থাকার কথা, পছন্দর অপাঠ্য বইগুলো পড়ার কথা। কারণ পাঠ্য বইগুলো সে পড়েছে পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের আশায়। অনেক ছাত্র আছে শুধু পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বাধ্য হয়ে এমন একটি বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করে যে বিষয়ে তার কোন আগ্রহ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টদের কদর বরাবরই অনেক বেশি। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে ছেলেটি একই বিষয়ে অনেক বেশি পড়াশুনা করে ভাল ফলফল করলো তাকে আমরা সেভাবে মূল্যায়ন করি না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেবাসটা অনেক বড়। এজন্য তাদেরকে বিষয়ের গভীরে গিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চেয়ে অনেক বেশি পড়তে হয়। জানতে হয়। তারপরও ভাল ফলাফল হয় না। চাকরির ইন্টারভিউতে সব সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অগ্রাধিকার পায় এতে তার বিষয়ভিত্তি জ্ঞান কম থাকলেও কোন সমস্যা নেই।
বাংলাদেশে নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াকেই অনেকে বড় যোগ্যতা মনে করেন, পরবর্তীতে লেখাপড়ায় তেমন মনযোগী না হলেও চলে।
বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া মানে সোনার হরিন হাতে পাওয়া। যে প্রক্রিয়ায় পরীক্ষাটি হয়, এতে কী প্রকৃত মেধার বিকাশ ঘটে? ছাত্ররা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে যতটুকু পরিশ্রম করে তারচেয়ে বেশী পরিশ্রম করে বিসিএস গাইড আর বিসিএস পরীক্ষা কোচিং নিয়ে। বিসিএস কোচিং দেশের সেরা বিদ্যাপীট! স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে যদি বিসিএস কোচিং করে মেধা যাচাই করতে হয় তাহলে উচ্চশিক্ষার জন্য এতো এতো বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর প্রয়োজন কী? সবচেয়ে ভাল হয় এসএসসি পাশ করে দুই বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়া। এতে ছাত্রদের সময়টা বাঁচলো, সরকারেরও উচ্চশিক্ষায় হাজার হাজার কোটি টাকা খরছ সাশ্রয় হবে। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, বর্তমানে বিসিএস সহ অন্যান্য নিয়োগ পদ্ধতিতে ‘সর্ব বিষয়ে’ মোটামুটি জানা একজনকে নেয়া হচ্ছে; তাহলে প্রশ্ন হলো, ব্যাচেলরে ৪ বছর আর মাস্টার্সে এক বছর পড়ার কি সত্যিকারের কোন দরকার ছিল? এগুলো শুধু শুধু সময়ের অপচয় নয় কী?
কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম যিনি বিসিএস পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছেন তিনি নাকি অনার্স ফ্যাইন্যাল পরীক্ষা দেওয়ার আগে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং করেছেন বলেই এই সাফল্য। সব কৃতিত্ব কোচিং সেন্টারের! এই যদি হয় মেধার বিকাশের চালচিত্র তাহলে জাতির কপালে নির্ঘাত দুঃখ আছে।
বিসিএস পরীক্ষার্থীরা গাইডের বদৌলতে জানেন, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েভের (www) আবিষ্কারক টিমথি বার্নার্স লির নাম। কিন্তু কোনদিন তাঁর আবিষ্কার ও গবেষণা নিয়ে পড়াশুনা করেন নাই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক এ্যারিস্টটলের নাম জানেন কিন্তু তাঁর জীবন ও দর্শন নিয়ে কোনদিন পড়াশুনা করেন নাই। পৃথিবী বিখ্যাত কবি শেক্সপিয়ারের নাম গাইড বইয়ে পড়েছেন কিন্তু একটি কবিতাও জীবনে পড়ে দেখেন নাই। নাম মুখস্ত করে আর যাই হোক মেধার বিকাশ কখনো সম্ভব নয়।
একজন ভাল গায়ক, একজন ভাল সাহিত্যক, একজন ভাল মেকানিক্স, একজন ভাল খেলোয়ায়ড়, একজন ভাল সমাজকর্মী যাদের একাডেমিক আহামরি কোন কৃতিত্ব নেই, তারা কী মেধাবী নয়?
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের দু’জন শিক্ষার্থী ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। অথচ বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়নি তাদের। এমনকি এ+ না থাকায় বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় ফরম ফিলাপ করতে পারেনি!
লন্ডনে কিছুদিন স্কুলে পড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। ওদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাকে অবাক করেছে। ওরা কোন ছাত্রকে জোর করে পড়ায় না। ক্লাসে অন্যদের সাথে পেরে না উঠলে আলাদা করে কেয়ার করে। তারপরও না পারলে রেখে দেয়। শুধুমাত্র প্রকৃত মেধাবীদের এরা পুস করে আর ভাল করার জন্য। এ হার শতকরা ২৫-৩০%। কিন্তু কখনো এদেরে প্রেসার দেয় না। ছাত্ররা যাতে মনের আনন্দে পড়াশুনা করে তার ব্যবস্থা করে দেয়। এদের আলাদা কোচিং লাগে না, টিচারের বাসায় গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করা লাগে না। এমনকি বাসায় এসে সর্বোচ্চ ২-৩ ঘন্টা পড়াশুনা করে। গার্ডিয়ানদের কোন হেল্প লাগে না।
ওদের সিলেবাসটা আমাদের চেয়ে ছোট, বইয়ের সংখ্যাও অনেক কম। এরা এ+ এর ফ্যান্টাসিতে ভোগে না। স্কুল থেকে ছাত্রদের সহজাত প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করে। তাদের ইচ্ছার বিরূদ্ধে যায় না। এজন্য মেধাবীরা স্বাধীনভাবে তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে। এজন্য আমাদের ছাত্রদের তুলনায় এরা অনেক মেধাবী হয়। একেকটা ছাত্র একজন গবেষক হয়। কারণ ছোটবেলা থেকে ছাত্রদের এরা থিংকার বানায়, তোতাপাখি নয়।
আমরা জোর করে মেধাবী বানাতে চাই, আর ওরা মেধাবীদের চেনে গবেষক বানায়। এখানেই আমাদের সাথে তাদের পার্থক্য। তারা জানে মেধা হচ্ছে সহজাত। জোরাজুরিতে হয়ত পরীক্ষায় ফল আসে, কিন্তু দেশ ও জাতির কোন লাভ হয় না। ইউকেতে এখনো GCSE পাশের হার ৬০-৬৭% (Gcse.result.2017)। গত ৫-৭ বছর আগেও ছিল ৪০-৪৫%।
আমি অনেক মাদ্রাসা শিক্ষিত ছাত্রকে দেখেছি অত্যন্ত মেধাবী। দেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষিত “ন্যাচারাল ট্যালেন্ট” ছাত্র-ছাত্রী আছে। আমরা তাদেরকে চিনি না। চেনার চেষ্টা পর্যন্ত করি না। একটা সহজ ট্যাগ লাগিয়ে দেই “মাদ্রাসা ছাত্র”। অবহেলা করি। এই অবহেলা আর সুযোগের অভাবে একটা সময় হতাশ হয়ে এই প্রতিভাগুলো ঝরে পড়ে। আমরা তাদেরকে উৎসাহ দেই না। আপনা লোক ভাবি না। অথচ এই ছেলেরাই সবচেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক হয়। দেশের জন্য ভাল কিছু করতে চায়। কিন্তু বিভাজন ও মানুষকে অবমূল্যায়নের রাজনীতি আর সামাজিক অঘোষিত প্রথা তাদেরকে দূরে ঠেলে দেয় চিরতরে, ফোকাস হওয়ার আগেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন লেখাপড়ায় ভীষণ অমনোযোগী। অনেকবার প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেন নাই। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন, কিছুদিন আগে মারা যাওয়া এ শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং একাডেমিক ইয়ারগুলোতে ভাল ছাত্র ছিলেন না। মাওলানা ভাসানি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও মাজারি মানের ছাত্র ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম তো পড়াশুনা করাই সুযোগ পান নাই। রুটির দোকানে চাকরি করেই শৈশবটা কেটেছে তার।
আপনি কী জানেন, টেকনোলজি জায়ান্ট এ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জব গ্রেজুয়েট নন। আলীবাবার প্রতিষ্ঠাতা চায়নিজ জ্যাক মা পড়ালেখায় খুব অমনোযোগী ছিলেন বলে চারবারে মেট্রিক পাশ করেন। ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্জ জোকারবার্গ তার উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাসপেন্ড হয়েছিলেন।
পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের নাম নিশ্চয় শুনেছেন। নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী এ বিজ্ঞনী বিখ্যাত E=MC2 সূত্রের উদ্ভাবক (E=mc2)। এছাড়া বিজ্ঞান গবেষণায় ৩০০টির বেশি রিসার্চ পেপার আছে তাঁর। তিনি ছিলেন হাইস্কুল ড্রপআউট। আমেরিকার বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টুয়েন ছিলেন অল্পশিক্ষিত, একটি প্রিন্টিং প্রেসের কর্মচারী। বিশ্ব বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম সেক্সপিয়ার ১৩ বছর বয়সে পড়ালেখা বাদ দিয়েছিলেন। আর স্কুলে যান নাই। (Albert.Einstein)।
সাধারন শিক্ষা আর উচ্চশিক্ষার মধ্যে অনেক গুণগত পার্থক্য আছে; ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত শিক্ষা স্তর হলো সাধারন শিক্ষা; আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষা হলো গবেষণামূলক শিক্ষা (যদিও এমনটি হয় না এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে)। যার ফলে লক্ষ লক্ষ উচ্চ শিক্ষিত মানুষের ভীড়ে হাতে গোনা কয়েকজন গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী ও সাইন্টিস্ট পাওয়া যায়। উচ্চ শিক্ষা সার্টিফিকেট ধারীদের জন্য নয়; এটি প্রকৃত মেধাবী ও গবেষকদের বিচরণ ক্ষেত্র। গত কয়েক বছরে শিক্ষা ব্যবস্থা কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ানটিটিকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়ছে; ফলে শিক্ষার মান কমেছে, কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
পরীক্ষায় ভাল ফলাফলকারী অনেকেই মেধাবী এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের দেশে যে প্রক্রিয়ায় মেধা যাচাই করা হয় তা সঠিক নয়। দেশকে এগিয়ে নিতে প্রকৃত মেধাবীদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদেরকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে। নিজেদের প্রতিভা বিকাশের জন্য কাজের পরিবেশ করে দিতে হবে। স্বীকৃতি দিতে হবে। আর এভাবেই দেশ এগিয়ে যাবে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো সাথে পাল্লা দিয়ে।
সার্টিফিকেট তো আমাদের আছে………
তাহলে আমরা কোথায় পিছিয়ে আছি; মেধায়? প্রতিভায়? জ্ঞানে?
নাকি, তিনটিতেই!!!