মালদ্বীপ থেকে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের ৬৬ শতাংশই হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে টাকা পাঠান। ৪১ শতাংশ ব্যাংক বা মানি ট্রান্সফারের মাধ্যমে টাকা পাঠান। আবার ৬৪ শতাংশেরই কোনো ব্যাংক হিসাব নেই। মালদ্বীপ থেকে নিয়মিত শ্রমিকেরা বছরে গড়ে তিন লাখ টাকার বেশি এবং অনিয়মিত শ্রমিকেরা গড়ে দুই লাখ টাকার বেশি প্রবাসী আয় দেশে পাঠাচ্ছেন।
দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহায়তায় রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) মালদ্বীপে বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের পরিস্থিতি নিয়ে ‘বাংলাদেশ ডাইনামিকস অব বাংলাদেশ অ্যান্ড দ্য মালদ্বীপস করিডর’ শিরোনামের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
রাজধানীর একটি হোটেলে গত বুধবার এ গবেষণার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি মালদ্বীপে অভিবাসনের বিভিন্ন দিক নিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন।
আলোচনায় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক শহীদুল আলম বলেন, মানব পাচারের ঝুঁকির তালিকায় থাকা মালদ্বীপে বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ শ্রমিকদের যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে আছে ২০১৯ সাল থেকে। আবাও শ্রমিকেরা যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে মালদ্বীপের নতুুন সরকার।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে বলা হয়, মালদ্বীপে শ্রমিকেরা আর্থিক, আইনগত, সামাজিক এবং স্বাস্থ্যসম্পর্কিত নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। তারপরও অন্যান্য দেশের তুলনায় শ্রমিকদের মালদ্বীপে যেতে খরচ কম লাগে। ভিসা পাওয়াও তুলনামূলক সহজ। এ কারণে বাংলাদেশের শ্রমিকদের ৯০ শতাংশই জানিয়েছেন, অভিবাসনের জন্য তাঁদের পছন্দের তালিকায় দেশটি ছিল।
গবেষণাটি প্রসঙ্গে রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, মালদ্বীপে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তবে সবাই নিয়ম মেনে বা গুছিয়ে দেশটিতে যেতে পারছেন, তা নয়। যেসব শ্রমিক দেশটিতে আছেন, তাঁদের সম্পর্কেও তেমন কিছু জানা যায় না। দেশটির শ্রমবাজার এবং শ্রমিকেরা কেমন আছেন, তা জানার জন্যই প্রাথমিকভাবে এ গবেষণা করা হয়।
এশিয়া ফাউন্ডেশনের এদেশীয় প্রতিনিধি কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ বলেন, গবেষণাটি মালদ্বীপের অভিবাসন বিষয়ে নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে সহায়তা করবে।
গবেষণার বিভিন্ন তথ্য
অনুষ্ঠানে গবেষণার বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হক। তিনি জানান, মালদ্বীপের নথিপত্রপ্রাপ্ত (৮৩%) এবং নথিপত্র নেই, এমন (১৭%) শ্রমিকদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। দেশে ফিরে আসা ২৫০ জন এবং মালদ্বীপে থাকা ১২০ জন শ্রমিকের কাছ থেকে এসব তথ্য নেওয়া হয়েছে। তাঁদের ১৮ শতাংশ জানিয়েছেন, মালদ্বীপে গিয়ে তাঁরা শারীরিক ও অন্যান্য নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। আর ৫৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁদের পরিচিতরা মালদ্বীপের নারীদের বিয়ে করেছেন। একইভাবে নারীরা মালদ্বীপের পুরুষদের বিয়ে করেছেন। মাত্র ২ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন।
গবেষণায় ৯৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা আত্মীয় এবং অন্যান্য এজেন্টের মাধ্যমে মালদ্বীপকে গন্তব্যস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছেন। দেশটিতে যেতে গড় অভিবাসন খরচ ২ লাখ থেকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, অভিবাসনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তিন মাস লাগে। ৯১ শতাংশ জানিয়েছেন, দেশটিতে যাওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে তাঁরা চাকরি পেয়েছেন।
অভিবাসী শ্রমিকদের মাসিক গড় আয় বাংলাদেশি টাকায় ৩৫ হাজার টাকা। অনিয়মিত শ্রমিকদের মাসিক বেতন ২৫ হাজার টাকার একটু বেশি। শ্রমিকদের সপ্তাহে ৬ দিন ১১ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। অনিয়মিত শ্রমিকদের দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়।
নিউইয়র্কের ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ারের পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান গবেষণার বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন। তিনি শ্রমিকদের ওই দেশের ভাষা জানা এবং আইনি সহায়তার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।
আলোচনায় সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে শ্রমিকদের যত দিন লাভ হবে না, তত দিন তাঁদের হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যাবে না।
মালদ্বীপের সাবেক হাইকমিশনার রিয়ার অ্যাডমিরাল (অবসরপ্রাপ্ত) এ এস এম এ আওয়াল এবং সাবেক হাইকমিশনার কাজী সারোয়ার হোসেন তাঁদের অভিজ্ঞতায় বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন। তাঁরা দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।
আলোচনায় সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী, সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা রোজানা রশীদ, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা কাজী আবুল কালাম, বায়রার সেক্রেটারি জেনারেল আলী হায়দার চৌধুরী, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের বিশেষজ্ঞ নুরুল ইসলাম, রিক্রুটিং এজেন্সি রিয়াজ ওভারসিজের প্রেসিডেন্ট রিয়াজুল ইসলাম প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।