কোনো এক ‘ফাল্গুনের রাতের আঁধারে, যখন ডুবে যায় পঞ্চমীর চাঁদ, মরণের সাধ জাগে দুর্নিবার।’ বাস্তবতা ভিন্ন, বাস্তবতা কল্পনার মতো নয়। একজন মানুষ হিসেবে আমাদের পক্ষে খুব কঠিন। ভিন্ন আরেকজনের মানসিক কষ্ট বোঝা, সত্যিকার অর্থে তা অনুভব করা। অধিকাংশ মানুষ এটি বোঝেই না যে বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে কেন লোকে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।
অনেক রোগী চিকিৎসকদের বলেছেন, তারা যখন আত্মহত্যা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাদের নিজেদের ব্যথাটাই এত বেশি ছিল যে তখন তারা তাদের প্রিয়জনদের কথা ভাবেনি। মনে হতেই পারে এটা খুব স্বার্থপরের মতো আচরণ। কিন্ত আসলে তা নয়। মানুষ আত্মহত্যা করে শুধু নিজে পালিয়ে বাঁচার জন্য। সে আসলে নিজে বাঁচার উপায় হিসেবেই মৃত্যুকে বেছে নেয়।
এদের চলে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকলেও, মূল কারণ কিন্তু একটাই, আর সেটা হচ্ছে মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা এবং হতাশা। যা তারা বহন করতে পারেনি। আমরা সবাই এখন এক অর্থহীন দৌড় প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যেখানে জীবন মানেই অর্থহীন লোক দেখানো ছুটে চলা।
এই অস্বাভাবিক ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের হতাশা ও বিষণ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। হতাশা মানুষের সৃজনশীলতা, বিবেকবোধ ও বুদ্ধিমত্তা নষ্ট করে দিচ্ছে। পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মানুষকে আরও চাপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
কখন যে কোথা থেকে মানুষের মনে ভর করে আকাশ সমান ক্লান্তি, বিষণ্ন তার কালো মেঘ আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে। জীবন হয়ে ওঠে এক অসহ্য যন্ত্রণার নাম। রাজ্যের নৈরাশ্য গ্রাস করে, ঘুম কেড়ে নেয় তার।
কোনো এক ‘ফাল্গুনের রাতের আঁধারে, যখন ডুবে যায় পঞ্চমীর চাঁদ, মরণের সাধ জাগে দুর্নিবার।’ প্রেম, স্নেহ-পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য, ঘৃণা, পিছুটান তুচ্ছ মনে হয়। অর্থশূন্য মানবজীবনের অবসানই একমাত্র কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে তখন।
অনেক সময় অন্যের মন খারাপকে আমরা পাত্তা দেই না। ভাবি হয়ত এটি সামান্য ব্যাপার, সাধারণ মন খারাপ। কিন্তু এভাবে চিন্তা করা মোটেও ঠিক নয়। চরম হতাশায় থাকা ব্যক্তির প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে।
অস্বাভাবিক চাপের মুখোমুখি হয়ে অনেকেই আত্মহত্যার কথা ভাবে কিন্তু সেই ভাবনাটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক ভাবনা। তবে এই ভাবনাটাই যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তখুনি রোগী তা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যায়।
জীবনকে উপভোগের জন্য খ্যাতি-বিত্ত নয়, সস্তা বিনোদন কিংবা একঘেয়েমি জীবন নয় বরং আনন্দের যে পথটা সেটা জানা দরকার, বোঝা দরকার। সেই পথ জানা থাকলে আপনাকে আর আত্মহত্যা করতে হবে না। জীবনে চলার পথে আত্মবিশ্বাস খুবই দরকার।
আপনি চলে গেলে মানুষ ভুলে যাবে, পরিবারে শূন্যতা সৃষ্টি হবে। অথচ আপনি যদি সমাজের বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন, নিজের মতো বাঁচতে পারেন তবে এই সমাজ, এই মানুষগুলোই মনে রাখবে আপনাকে।
মানসিক চাপকে আমরা খুব ভারি বা মোটামুটি ভারি কোনো জিনিসের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। মোটামুটি ভারি কোনো জিনিস আমরা নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত হাতে ধরে রাখতে পারব। এখানে জিনিসটির ওজন কোনো ব্যাপার নয়। ব্যাপার হচ্ছে আমরা কতক্ষণ এটি ধরে আছি। যত বেশি সময় ধরে থাকব, তত বেশি হাতটা অবশ হতে থাকবে।
এই ভারি জিনিসটির মতোই হচ্ছে মানসিক চাপ। প্রচন্ড কোনো মানসিক চাপ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমরা সহ্য করে নিলেও নিতে পারি, কিন্তু সেই চাপের সময়সীমা দীর্ঘস্থায়ী হলেই বাঁধে বিপত্তি। মানুষ তখন সেই চাপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। এ রকম কোনো এক পর্যায়েই মানুষ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
শুধু একটাই ব্যাপার, এই সময়টা একজন প্রিয় মানুষের উপস্থিতি লাগে, যে সময়ে অসময়ে পাশে থাকবে। মানসিক সাপোর্ট দেবে, পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করবে। প্রতিটা মিনিট, ঘণ্টা আমার কেয়ার নিতে ব্যস্ত থাকবে। সে কখনো আমায় ভুল বোঝাবে না অহেতুক এই হঠাৎ মন খারাপের জন্য প্রশ্ন তুলবে না।
মন খারাপের সময় বারবার মন খারাপের কারণ জানতে চেয়ে আরও মন ভারি করে দেবে না। বরং আমার সময়টাকে পুনরুদ্ধার করতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। বাস্তবতা ভিন্ন, বাস্তবতা কল্পনার মতো নয়।