গাজায় তীব্র বোমাবর্ষণের বিষয়ে কোনো গোপনীয়তা রাখেনি ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। আক্রমণের শুরুর দিকে দেশটির বিমান বাহিনী প্রধান নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলার কথা জানিয়েছিলেন। তবে বলেছিলেন, তারা কেবল হামাসের সামরিক টার্গেটগুলোতে আঘাত করছেন এবং যোগ করেন যে, তারা ‘সার্জিক্যাল’ নন।
গাজায় টার্গেট চিহ্নিতকরণে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) কী কী পদ্ধতি অবলম্বন করছে এবং তাদের এই নির্বিচার বোমাবর্ষণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা কী, সেদিকে খুব একটা মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
সাতদিন যুদ্ধবিরতির পর আবারও গাজায় হামলা জোরদার করেছে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এ পর্যন্ত ১৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
নিত্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সামরিক সক্ষমতার পাশাপাশি নিজের মর্যাদাও বাড়িয়েছিল ইসরায়েল। ২০২১ সালের মে মাসে গাজায় ১১ দিন যুদ্ধ শেষে ইসরায়েলের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, এটি তাদের প্রথম ‘এআই যুদ্ধ’। এই যুদ্ধে তারা যান্ত্রিক ভাষা ও উন্নততর গণনাকৌশল ব্যবহার করেছিলেন।
হামাসের সঙ্গে চলমান যুদ্ধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আরও বড় পরিসরে ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে আইডিএফ। বিশেষত তাদের তৈরি এআই-চালিত টার্গেট শনাক্তকরণ ব্যবস্থা ‘দ্য গসপেল’-কে মোতায়েনের সুযোগ এসেছে। তবে যন্ত্রটি শত্রুপক্ষের সন্দেহভাজন টার্গেট এতো বেশি উৎপন্ন করে যে, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এটিকে ‘কারখানা’র সঙ্গেও তুলনা করেছেন।
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের ক্রীড়নক কি এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্লাটফর্ম গসপেল? ইসরায়েলি গোয়েন্দা সূত্র, আইডিএফ ও এর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য হাজির করেছে দ্য গার্ডিয়ান।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই ব্যবহারের ছবি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে জটিল ও অস্বচ্ছ স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের ব্যবহারের প্রসারে বেসামরিকদের প্রাণহানির শঙ্কাও বাড়ছে।
হোয়াইট হাউসের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অন্যান্য দেশগুলো দেখছে এবং শিখছে। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতে পারে, যদি ইসরায়েল সঠিক উপায়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাতে পারে।’
বছরে ৫০ থেকে এখন দিনে ১০০ টার্গেট উৎপাদন
নভেম্বরের শুরুতে আইডিএফ জানিয়েছিল, তাদের টার্গেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ গাজায় ১২ হাজারের বেশি টার্গেট শনাক্ত করেছে। ইসরায়েলি এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শত্রু কে ও কী, তা চিহ্নিত করতে আমরা নিরলস কাজ করছি। হামাসের যোদ্ধারা যেখানেই লুকিয়ে থাকুক, সুরক্ষিত থাকবে না।’
২০১৯ সালে গঠিত টার্গেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের কার্যক্রম গোপন রাখলেও আইডিএফ তাদের ওয়েবসাইটে জানায় যে, তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত সিস্টেমের নাম ইয়াবসোরা (ইংরেজিতে দাঁড়ায় গসপেল)। দ্রুতগতিতে হামাসের টার্গেট শনাক্তকরণই এর কাজ।
আইডিএফ জানায়, গসপেল যন্ত্রটি তার চালকদের টার্গেট শনাক্তের জন্য নির্দেশনা দিয়ে যেতে পারে এবং সে নির্দেশনা অনুযায়ী টার্গেটকে শনাক্তও করা যায়।
আইডিএফের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র গার্ডিয়ানকে জানায়, হামলার টার্গেট নির্ধারণে গসপেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরামর্শ দেয়। যেমন- হামাস ও ইসলামিক জিহাদ সংশ্লিষ্টদের গোপন আস্তানা অনুমান করে।
গত কয়েক বছরে টার্গেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের সহায়তায় আইডিএফ ৩০-৪০ হাজার সন্দেহভাজনের একটি ডেটাবেজ তৈরি করেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত আইডিএফের প্রধান থাকা আভিভ কোচাভি জানান, টার্গেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত এবং এই বিভাগে শতাধিক কর্মকর্তা ও সেনা রয়েছে।
কোচাভি জানান, ২০২১ সালের মে মাসে ১১ দিনের যুদ্ধে চালুর পর দিনে ১০০টি টার্গেট উৎপাদন করে গসপেল।
তিনি বলেন, ‘অতীতে আমরা বছরে কেবল ৫০টি টার্গেট চিহ্নিত করতে পারতাম, এখন এই যন্ত্রের সাহায্যে দৈনিক ১০০টি টার্গেট চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে। এরমধ্যে ৫০ ভাগ টার্গেটে আঘাত করা হচ্ছে।’
গসপেলে কোন ধরনের ডেটা সন্নিবেশিত করা হয় তা জানা যায়নি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এআই-ভিত্তিক এই সিস্টেমে ড্রোন ফুটেজ, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ, নজরদারির তথ্য, ব্যক্তি ও দলের নড়াচড়া এবং আচরণিক ধরন থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বড় পরিসরে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম গসপেল।
এই টার্গেট ডিভিশনটি আইডিএফের দীর্ঘস্থায়ী একটি সমস্যাকে চিহ্নিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। গাজায় চালানো শুরুর দিকের অপারেশনগুলোতে বিমানবাহিনী লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল। হামাসের যোদ্ধারা সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে আত্মগোপন চলে যাওয়ায় তাদের শনাক্তে গসপেলের মতো ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়।
গাজায় অতীতে চালানো অপারেশনগুলোর সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা গার্ডিয়ানকে জানান, অতীতে হামাসের ছোট সারির সদস্যদের অবস্থান টার্গেট করা হতো না। এখন আর র্যাঙ্ক মানা হচ্ছে না। গসপেলের সহায়তায় এখন গাজাজুড়ে ছড়ানো হামাসের ছোট-বড় সব সন্দেহভাজন কর্মকর্তার অবস্থান টার্গেট করে বোমা হামলা চালানো হচ্ছে।
এআই টার্গেট বেসামরিকদের মৃত্যুর পথ করে দিচ্ছে
যদিও আইডিএফের টার্গেট ডিভিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘হামাসের সঙ্গে সম্পর্কিত অবকাঠামোগুলোতে হামলার পাশাপাশি বেসামরিক নাগরিকদের যেন ক্ষতি না হয়, তা খেয়াল করা হচ্ছে।’ ইসরায়েলি পত্রিকা ইয়েদিওথ আহরোনোথ জানাচ্ছে, ‘এআই টার্গেট ব্যাংক’ যে টার্গেটগুলোর কথা বলছে, তাতে বেসামরিক নাগরিকদের কোনোরকম ক্ষতি যেন না হয়, তা নিশ্চিত করা হবে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাবেক এক কর্মকর্তা গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘আমরা এমন অ্যালগরিদম ব্যবহার করছি, যাতে কোথায় কত সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক আছে, তা বোঝা যাবে। এটি ট্রাফিক সিগনালের মতো সবুজ, হলুদ ও লাল সিগনাল দেয়।’
এআই ও সশস্ত্র দ্বন্দ্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা গার্ডিয়ানকে জানান, এআই-ভিত্তিক এই ব্যবস্থাপনা নিখুঁত লক্ষ্যভেদের মাধ্যমে বেসামরিক ক্ষতিসাধন কতটা কমাতে পারবে, তা নিয়ে তারা সন্দিহান।
গবেষক রিচার্ড মোয়েস গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘গাজার প্রকৃত চিত্র দেখুন। ভারী বিস্ফোরক দিয়ে বিস্তৃত শহরতলীকে একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
নভেম্বরে আইডিএফের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, যুদ্ধের প্রথম ৩৫ দিনে ইসরায়েল গাজায় ১৫ হাজার টার্গেটে হামলা চালায়, যা অতীতের অপারেশনগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। ২০১৪ সালে চলা ৫১ দিনব্যাপী যুদ্ধে আইডিএফ ৫-৬ হাজার টার্গেটে হামলা করেছিল।
হামাস বা ইসলামিক জিহাদের কোনো সদস্যের বাড়িতে হামলা চালালে কী পরিমাণ বেসামরিক মানুষ মারা যাতে পারে, টার্গেট গবেষকরা সে সম্পর্কে আগেই ধারণা করতে পারেন।
২০২১ সাল পর্যন্ত আইডিএফে কর্মরত এক সূত্র জানায়, একজন ইউনিট কমান্ডার হামলার সিদ্ধান্ত নেন। যাদের কেউ কেউ হামলা চালাতে পারলেই খুশি। অনেক সময় কোনো টার্গেট নিয়ে সন্দেহ হলে এর বাইরে হামলা চালিয়ে বেসামরিক হত্যার ঘটনাও ঘটে।
গণহত্যা কারখানা
এআইভিত্তিক সিস্টেম টার্গেট শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াটিকে উল্লেখযোগ্য গতি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এক সূত্র গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে টার্গেটগুলো চিহ্নিত করি ও চেকলিস্ট অনুসারে কাজ করি। এটি আসলেই একটি কারখানার মতো। আমরা দ্রুত কাজ করি, ফলে টার্গেট যাচাই-বাছাইয়ের সময় থাকে না। আমরা কতগুলো টার্গেট চিহ্নিত করতে পারলাম, তা দিয়ে নিজেদের মূল্যায়ন করি।’
পৃথক আরেক সূত্র জানায়, গসপেলের সহায়তায় ‘গণহত্যা কারখানা’ চালু করেছে আইডিএফ। তাদের মনোযোগ মানে নয়, পরিমাণে। প্রতিটি হামলার আগে মানব চোখে টার্গেটগুলো পরখ করে নেওয়া হয়, তবে খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না।
স্টকহোম আন্তর্জাতিক পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. মার্টা বো বলেন, মানুষ যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে, তখন তার অটোমেশনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে, ফলে তার সিদ্ধান্ত যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল ৩৬ এর পরিচালক রিচার্ড মোয়েস বলেন, ‘গসপেলের মতো যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হলে, একজন কমান্ডারের হাতে কম্পিউটারে তৈরি একটি তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হবে। কীভাবে তালিকাটি করা হয়েছে তা জানাটিও তাদের জন্য আবশ্যক নয়। টার্গেট নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন বা অনুসন্ধানের সুযোগও তাদের থাকবে না।’
‘তবে বিপদ হলো- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত এমন সিস্টেমের ওপর নির্ভর করতে গিয়ে মানুষ পরিণত হবে যন্ত্রচালনাকারী চাকায়, তখন অর্থপূর্ণ উপায়ে বেসামরিক ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করার ক্ষমতাও তারা হারিয়ে ফেলবে’, যোগ করেন তিনি।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান