দ্রব্যমূল্য দিন দিন লাগামহীন হয়ে ওঠায় ভালো নেই কুমিল্লার মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যে হারে আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে, সে অনুপাতে বাড়ছে না তাদের আয়। ফলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জীবনযাপনে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। মাসিক আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মিলাতে পারছেন না তারা।
খুচরা সবজি ব্যবসায়িরা জানান, পাইকারি বেশি মূল্যে কেনা হওয়ায় বেচতে হচ্ছে বেশি মূল্যে। পাইকারী বাজারে আড়তদারদের সিন্ডিকেটের কারণে সরবরাহ কমে গেছে বাজারে, দাম বাড়ানো হয়েছে কৃত্রিমভাবে। প্রশাসনকে নজর দিতে হবে পাইকারী আড়তদার ও নিমসার কাচা বাজারে।
বৃহস্পতিবার বিকালে কুমিল্লা নগরের রাজগঞ্জ ও নিউমার্কেট এলাকায় বিভিন্ন সবজির দোকান ঘুরে দেখা গেছে এক এক দোকানে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে একই সবজি। ডিমের দামও এক এক দোকানে এক এক রকম।
কান্দিরপাড়ে ভ্যানে করে নিয়মিত সবজি বিক্রি করা মোঃ রাসেল জানান, আমাদেরকে বলে কিছু লাভ নেই। নিমসার থেকে কেনা বেশি তাই বিক্রিও বেশি। পাইকারী দাম এত বেশি যে আমরা নিজেরাও অবাক!
বিক্রেতা রাসেল জানান, পাইকারী দরে যে দামে বৃহষ্পতিবার মাল এনেছি তার তালিকা হলো- কেজি প্রতি মরিচ- ৩৬০-৪০০টাকা, ধনেপাতা- ৪৫০, টমেটো- ২২০, বাঁধাকপি ছোট- ৫০, পটল- ৭০, গোলবেগুন- ১৫০, লম্বা বেগুন- ৯০, কারকোল- ১০০, ঝিঙ্গা- ৭০, পেপে-৩০, মিষ্টি কুমড়া- ৬৫, শসা- ৬৫-৯০, কলা হালি- ৫০, গাজর-১৫০, করলা-৭০, ফুলকপি- ২০০, কইডা-৭২, ধুন্দুল-৭০, ছড়া-৫৭, বরবটি-১৩০টাকা। এই দামে কিনে দোকান ভাড়া আর লাভ রেখে বিক্রি করতে গিয়ে নিজেরাও হিমশিম খাই। তরকারি বেচে তরকারি খাওয়াও কষ্টকর।
নিউমার্কেটে ডিম দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, কোন দোকানে ডিমের হালি চাওয়া হচ্ছে ৬০ টাকা, আবার কোন দোকানে চাওয়া হচ্ছে ৫৮ টাকা। রাজগঞ্জ বাজারে কোথাও ৫৫ বা কোথাও ৫২ টাকা দরে ডিমের দাম চাওয়া হচ্ছে।শুধু জেলা পর্যায়ে নয়, উপজেলা পর্যায়ে সবজি ও তৈরি দরকার এর দাম যেন আরো বেশি। কথা হয় ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের নন্দিপাড়া এলাকার বাসিন্দা আক্তার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, একসময় ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে সেই চাকরিটা হারান। তারপর থেকে কিছু মাস বেকার ছিলেন। পরে চাকরিবাকরি না-পেয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। স্ত্রী সন্তান নিয়ে কোনোমতে চলছিল সংসার। তবে দিন দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হাতের নাগাল ছাড়িয়ে যাওয়ায় আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মিলাতে পারছেন না। এতে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
কথা হয় উপজেলার বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর এলাকার বাসিন্দা আরিফ আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি। সীমিত টাকা বেতন পাই। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে দিন দিনই আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পাল্লা ভারি হচ্ছে। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ৫ সদস্যদের সংসার খরচের জোগান দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছি।
সাহেব আলী (দিনমজুর) দেবিদ্বার উপজেলার ইউসুফ পুর ইউনিয়নের এগারগ্রাম এলাকার বাসিন্দা। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ৬ সদস্যের সংসার তার। প্রতিদিন হাতে কাজ থাকে না তার। বাজারে জিনিসপত্রের দাম দিন দিন বাড়ায় সংসারের ঘানি টানতে কষ্ট হচ্ছে তার।
তিনি বলেন, বাজারে গেলে জিনিসপত্রের দাম শুনে মাথা ঘুরে যায়। যে টাকা নিয়ে বাজারে যাই তাতে সংসারের চাহিদা অনুযায়ী বাজার আনতে পারি না। পেটের ক্ষুধা তো এতকিছু বোঝে না। ছেলেসন্তান নিয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছি।
ব্রাহ্মণপাড়া পশ্চিম বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজল সরকার বলেন, কয়েকদিনের বৃষ্টিতে সবজি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায় বাজারে সবজির দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আশা করছি খুব শিগগিরই সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে আসবে সবজির দাম। এছাড়া অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও কিছুটা কমে আসবে। অযৌক্তিকভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জিনিসপত্রের দাম যেন কোনো দোকানি না বাড়ায় সে বিষয়ে আমরা তৎপর আছি।
এদিকে বাজার মনিটরিং এর জেলা পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে টাস্ক ফোর্স। বৃহস্পতিবার বিকেলে কুমিল্লা জেলার রাজগঞ্জ বাজারে টাস্ক ফোর্স এর অভিযানে বিভিন্ন দ্রব্যমূল্যের বাজার মূল্য মনিটরিং করা হয়। এসময় বেশ কয়েকটি দোকানকে অনিয়মের অভিযোগে জরিমানা করা হয়। এ সময় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট- ভোক্তা অধিকারের উর্ধতন কর্মকর্তা, বাজার কমিটির নেতৃবৃন্দসহ টাস্কফোর্সের সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।
কুমিল্লা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ আসাদুল ইসলাম জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত ট্রাস্কফোর্স বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত কাজ করবে। দামের ঊর্ধ্বগতি কোথায় হচ্ছে সেটি খতিয়ে দেখবে টাস্কফোর্সের সদস্যরা।
রাজগঞ্জ বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাজী মোঃ সেলিম জানান, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে পাইকারি বাজারে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এছাড়া কোন সিন্ডিকেট দাম বাড়াচ্ছে কি না তা পাইকারী বাজারে অভিযান চালিয়ে নিয়ন্ত্রন করতে হবে।