বাঁশের তৈরি নান্দনিক জিনিসপত্র কেনার উদ্দেশে এ পর্যন্ত ২০টিরও বেশি দেশের মানুষ এসেছে এই গ্রামে। শুধু বিদেশি পর্যটক নয়, বিদেশি সংস্থাগুলোরও ভিড় ছিল আনন্দপুর গ্রামে। আনন্দপুর ও আশপাশের গ্রামের তিন শতাধিক পরিবার যুক্ত ছিল এই কুটির শিল্পের সঙ্গে।গ্রামজুড়ে ছিলো উৎসবের আমেজ।
কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার বাকশীমূল ইউনিয়নের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রাম আনন্দপুর। এক যুগ আগেও এ গ্রামে বিদেশিদের আনাগোনা ছিল।
দূর-দূরান্তের মানুষ ভিড় করতেন এসব গ্রামে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রির ধুম পড়ে যেত। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ছিল বেশ।সময়ের বিবর্তনে আনন্দপুরের সেই আনন্দঘন আবহ ম্লান হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত চাহিদা থাকলেও দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তির অভাবে এ শিল্পের উৎপাদন কমে গেছে।
বর্তমানে মাত্র ১১টি পরিবার যুক্ত আছে এই শিল্পের সঙ্গে। তাদের মধ্যে একজন মোহাম্মদ শাহ্ জামাল। তিনি কুমিল্লা আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসের স্বত্ত্বাধিকারী।সংগ্রামের আগ থেকে তার প্রয়াত বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেমের হাত ধরেই বুড়িচংয়ে এ শিল্প বিস্তার লাভ করে। এই শিল্পকে বাঁচাতে পরিবারের হাল ধরতে শাহ্ জামাল সংগ্রাম করছেন। তিনি আবারও ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে দিতে চান তার বাঁশের শো-পিস।চলতি মাসে শাহ্ জামালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রঙতুলি দিয়ে বাড়ির মাটির ঘরে বিশ্ব কবি রবিদ্রনাথ ঠাকুরের ছবি আল্পনা দিয়ে আঁকছেন এবং আল্পনা দিয়া আঁকানো ওয়ালমেট উঠোনে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। পাশে কাজ করছেন তার ভাই,প্রতিবেশীরা আরও কয়েকজন। কলমদানি আর ফুলদানি তৈরি করতে বাঁশ ছোট টুকরো করে কাটা হয়েছে। আগুন দিয়ে বাঁশে সেঁক দেওয়া হচ্ছে। সেই বাঁশ ঘষে পরিষ্কার করা হয়। তার ওপরে নানা রঙের ডিজাইন। হাত দিয়ে সব যত্ন সহকারে করা হচ্ছে। মাটির ঘরে বেতবোনার মেশিন। পাশে উৎপাদিত টেবিল ল্যাম্প, ফুলদানি, কলমদানি, ওয়ালমেট, ক্যালেন্ডার, দরজা-জানালার পর্দার সারি।বর্তমানে এই কুটির শিল্প পুঁজি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রযুক্তি থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে, যার কারণে উৎপাদনও বেশ কমে গেছে।
শাহ্ জামালের সঙ্গে কথা হলে তিনি এএনবি২৪ ডট নেটকে তিনি জানান ৫২টি পণ্য উৎপাদন করে আলপনা করেন তিনি। মাসে তার ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় হয়। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প পুরস্কার স্বর্ণপদক পান শাহ জামাল ,এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেও সম্মাননা পেয়েছেন।তবে দুঃখের অন্ত নেই তার। শাহ্ জামাল জানান আমার স্বপ্ন ছিল এ শিল্পে বড় অবদান রাখা ও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কুমিল্লায় প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাব নেই। কিন্তু দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। সময়ের দাবিতে প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে।
আরও পড়ুন,
- বিয়ানীবাজার, আবারও ন্যাশনাল ব্যাংকে তালা দিলেন গ্রাহকরা
- দুইপ্রীতি ম্যাচের প্রথমটিতে মালদ্বীপের কাছে হার বেদনাদায়ক, বললেন বাংলাদেশ কোচ
পুঁজি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রযুক্তি থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছি। যার কারণে উৎপাদনও বেশ কমে গেছে। শাহ্ জামাল আরও জানান, বাজারে বাঁশের তৈরি শো-পিসের ব্যাপক চাহিদা। ওই হারে উৎপাদন করার মতো প্রযুক্তি,দক্ষ জনশক্তি ও উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার জায়গার সঙ্কট আছে। যার কারণে লাভের ভাগীদার হয়ে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। জানা যায়, ১৯৮৬ সালে এসএসসি শেষ করে বাবা বীরমুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেমের বড় হয়ে ছেলে শাহ্ জামাল কুমিল্লা বিসিক থেকে কমার্শিয়াল আর্টের ওপর তিন বছরের কোর্স শেষ করে বাবার পেশায় পা বাড়ান। আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের আওতায় তিনি বুড়িচং উপজেলার বাকশীমুল ইউনিয়ন আনন্দপুর হাজি-বাড়ির পৈতৃক ভিটায় গড়ে তোলেন কুমিল্লা আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস্ নামক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্দেশ্য ছিল কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি তৈরি, প্রশিক্ষণ ও বিক্রয়। প্রথম দিকে বেশ সফল ছিলেন তিনি। ব্র্যাক ও বিসিকের সহায়তায় ৩ শত নারী ও পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেন তিনি। বিদেশি পর্যটক ও সংস্থাগুলোর আসা-যাওয়া চলছিল নিয়মিত। চীন, জাপান, কলম্বিয়া, থাইল্যান্ড, আমেরিকা,ইতালি ও ফ্রান্সের প্রতিনিধি দল সফর করেন শাহ্ জামালের প্রতিষ্ঠানে। ব্যবসা ভালোই চলছিল। কাঁচামালের সঙ্কট নেই, থেমে নেই উৎপাদনও। বিক্রিতেও কখনো ভাটা পড়েনি। কিন্তু বর্তমানের তাল মিলিয়ে নিতে পারচ্ছে না প্রযুক্তির কারণে।
মেশিনারি ও প্লাস্টিকের পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে পিছিয়ে পড়ে যান তিনি ও তার সহকর্মীরা। এদিকে তারা নিজেরাও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার মতো আর্থিক সঙ্গতি অর্জন করতে পারেননি। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এ পেশা ছাড়তে শুরু করেন অনেকেই। কুটির শিল্পী মো. শাহ্ জামালকে একজন পরিশ্রমী উদ্যোক্তা হিসেবে চিনে এ অঞ্চলের মানুষ। তার এ কাজকে এগিয়ে নিতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন আনন্দপুর গ্রামের মানুষেরা।
জানা যায়, ১৯৫৫ সালের পূর্ব থেকে কুমিল্লা কারাগারে কুটির শিল্পের পণ্য তৈরি হতো। শাহ্ জামালের বাবা বীর মুক্তিযুদ্ধা মরহুম আবুল হাসেম ফটোগ্রাফি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন সব সময়। সেই সময় কুমিল্লা কারাগারে চাকরি করা মহিউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি আবুল হাসেমকে পরামর্শ দেন বাঁশের তৈরি পণ্য তৈরি করার জন্য। ফটোগ্রাফার আবুল হাসেমের আর্টের হাত ভালো ছিল। তিনি মহিউদ্দিনের প্রস্তাব রাজি হয়ে যান । নিজ গ্রাম আনন্দপুরে এ শিল্পের উৎপাদন শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে এই কাজের প্রসার লাভ করে। বুড়িচংয়ের আনন্দপুর ,জঙ্গল বাড়ি, খাড়েরা, ছোট হরিপুর ও ছয়গ্রামের মানুষজন জড়িয়ে পড়েন এই পেশায়। স্বাধীনতা পরবর্তীতে নব্বই দশক পর্যন্ত বেশ দাপুটে অবস্থায় ছিল বাঁশ-বেত শিল্প। পরবর্তীতে প্লাস্টিকের পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। লাভ ও উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় বিমুখ হয়ে পড়েন কুটির শিল্পীরা। বর্তমানে এই নান্দনিক কোকুটির শিল্পকে আরো প্রসার করতে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয় সাধারণ এলাকার মানুষজন।