অল্প টাকা দিয়ে ডেলিভারি করিয়ে দেবে- এমন প্রলোভন দেখিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসে ফাতেমা বেগম নামের এক প্রসূতিকে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে দালালচক্র। সেখানে চিকিৎসকের অবহেলায় নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়াও পরিবারের কাছে নবজাতকের মৃত্যুর তথ্য গোপন রেখে দীর্ঘ সময় আইসিইউতে রাখার পর পরিবারকে মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং নবজাতকের মাকে হাসপাতালে আটকে রেখে বাচ্চার লাশ নিয়ে যেতে বাধ্য করেন কর্তৃপক্ষ।
এসব অভিযোগ উঠেছে নগরীর টমছমব্রিজ এলাকায় অবস্থিত হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় মঙ্গলবার বিকালে কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীর পরিবার।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত সোমবার রাতে বিষয়টি রফাদফা করতে ভুক্তভোগী পরিবারকে নিয়ে বসেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমন তথ্য পেয়ে সংবাদকর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে এর সত্যতা পায়। সরেজমিন ওই রাতে ঘটনা ধামাচাপা দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এলাকার ১৫-২০ জনকে নিয়ে বসে আলোচনা করে এবং ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে তা উপস্থিত লোকদের কাছে প্রদান করেন। এমনকি উপস্থিত একজন পরিচয় গোপন রাখা সংবাদকর্মীকে সেই টাকা দিতে চেষ্টা করেন কর্তৃপক্ষের একজন লোক।
পরিবারের অভিযোগ, সোমবার রাত ২টার দিকে কুমিল্লা সদর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটের ভিতরে গেলে এক দালাল রোগীর কাগজপত্র হাতে নিয়ে মেডিকেলের ডাক্তার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে অল্প টাকায় ডেলিভারি করিয়ে দেবে বলে প্রলোভন দেখায়। পরে সেখানে ভুক্তভোগী ফাতেমা বেগম নামে ওই রোগীকে ভর্তি করেন এবং রোগীর চিকিৎসার খরচ বাবদ টাকা চেয়ে নগদ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে কৌশলে পালিয়ে যান।
অন্যদিকে ভর্তিকৃত রোগী ফাতেমা বেগম ওই দিনই ভোর ৪টার দিকে সিজারের মাধ্যমে জীবন্ত এক নবজাতকের জন্ম দেন তিনি। পরে সেই নবজাতকের নাম রাখেন পরিবার আবু সাঈদ।
নবজাতকের বাবার অভিযোগ, সিজারের সময় ফাতেমা বেগমের তার অনুপস্থিতিতে পুরুষ মানুষ দিয়ে সিজার করানো হয়েছে।
ফাতেফা বেগম বলেন, যিনি আমার সিজার করেছেন তিনি পুরুষ মানুষ ছিলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি কোনো ডাক্তার ছিলেন না। তিনি আমার সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেছেন। এমনকি যে মৃত বাচ্চাটি আমাদের দিয়েছে সেই বাচ্চাটি আমার নয়, তারা বাচ্চা পালটিয়েছে।
বাচ্চার বাবা বলেন, বাচ্চাটি জন্মের পর ভালো ছিল এবং স্বাভাবিক ছিল; কিন্তু বাচ্চাটি তারা মায়ের কাছে না দিয়ে তারা অক্সিজেন দিতে হবে বলে নিয়ে যায়। পরে ২১ অক্টোবর ভোর ৪টা থেকে ২৩ অক্টোবর বেলা ১১টা পর্যন্ত বাচ্চাটি স্বাভাবিক থাকলেও বাচ্চাকে ৩ ব্যাগ রক্ত দিতে হবে বললে তা আমি এনে দেই। পরের দিন রাত ২টা ২০ মিনিটে আমাকে ফোন দিয়ে জানানো হয় যে, বাচ্চার অবস্থা খুবই গুরুতর। এ সময় আমি বাচ্চা দেখতে চাইলে তা দেখতে দেওয়া হয়নি। পরে জুমার নামাজের পর আমাকে ফোন দিয়ে ৫ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে যেতে বলেন তারা। ৫ মিনিট পরে এলে আপনার বাচ্চাকে আর দেখতে পাবেন না বলে জানান হাসপাতালের ম্যানেজার। পরে আমি ৭-৮ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত হলে আমাকে জানানো হয় আমার বাচ্চা মারা গেছে। এ সময় আমি বাচ্চা দেখতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা দেখতে না দিয়ে বাচ্চা ও বাচ্চার মাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেন এবং হাসপাতালের বিল বাবদ ৭৬ হাজার টাকা বুঝিয়ে দিতে বলেন; কিন্তু আমার কাছে এত টাকা তখন না থাকায় তখন তারা বাচ্চা ও বাচ্চার মাকে আটকিয়ে রেখে টাকা নিয়ে আসতে বলেন।
তিনি বলেন, পরে ওই রাত ১টার দিকে আমি কিছু টাকা নিয়ে গেলে তারা তাতে রাজি না হয়ে আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে খারাপ ব্যবহার করেন এবং মামলার ভয় দেখান। এ সময় বাচ্চার মাকে আটকিয়ে রেখে মৃত বাচ্চা নিয়ে যেতে বাধ্য করেন গভীর রাতে এবং হাসপাতালের ৭৬ হাজার টাকা নিয়ে আসতে বলেন তারা। পরে আমি বাচ্চার মাকে হাসপাতালে রেখে বাচ্চা নিয়ে এসে দাফন করে দেই।
তিনি আরও বলেন, পর দিন শনিবার ও রোববার আমাকে ফোন দিয়ে বিভিন্ন ধরনের গালিগালাজ করে মামলার কথা বলে টাকা নিয়ে আসতে বলেন হাসপাতালে। পরে সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে কয়েকজনকে নিয়ে গেলে আমার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে বাচ্চার মাকে মুক্তি দেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আমি এ ঘটনায় বিচার চাই এবং আমি আমার বাচ্চা ফিরে চাই। এ বিষয়ে আমি ঘটনার পরের দিন মঙ্গলবার থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি।
অভিযোগের বিষয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের বক্তব্য জানতে চাইলে মালিক পক্ষের রকিব নামে একজন উপস্থিত হয়ে বলেন, ভুক্তভোগী তো আমাদের সঙ্গে কথা বলে চলে গেছে, তাহলে আর কী। এ সময় হাসপাতালের বৈধ কোনো কাগজপত্র আছে কিনা জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেননি তিনি। রোগীর কাগজপত্র দেখতে চাইলেও তা দেখাতে পারেননি তিনি।
পরে হাসপাতালের মালিকপক্ষের আরেকজন সব দোষ স্বীকার করে সাংবাদিকদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। অপর আরেক সাংবাদিক হাসপাতালে ম্যানেজারকে কল দিলে তিনি জানান, মহিলা গাইনি ডাক্তার ওই প্রসূতিকে সিজার করিয়েছেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, পুরুষ ডাক্তার দিয়ে সিজার করিয়েছেন। তবে একই ম্যানেজারে দুই রকম জবাব দিয়েছেন। কথার একপর্যায়ে সাংবাদিককে সরাসরি দেখা করতে বলে কল কেটে দেন।
এ ঘটনায় কুমিল্লার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সিভিল সার্জন ডা. নাছিমা আক্তারকে ঘটনাস্থল থেকে সোমবার রাত ১০টা ৮ মিনিটে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।